| |

সব দল নিজেকে ইসলামের একমাত্র এজেন্ট মনে করেন

অনেকেই নিজের দলকে ইসলামের একমাত্র এজেন্ট মনে করেন, এবং কেউ নিজের দল থেকে বের হয়ে গেলে তাকে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়া বলে প্রচার করেন।

দুটি দেশে থেকে দুটি উদাহরণ দিচ্ছি।

ইন্টারনেটে একটি ভিডিও পেলাম। সেখানে জামায়াতে ইসলামীর এক নেতা বলছেন, “সম্মানিত ভাইয়েরা, (এবি পার্টি) তারা তাদের সেশনে বলেছে পরিষ্কার করে, তাদের কর্মসূচিতে ও তাদের এজেন্ডায় ধর্ম এবং মুক্তিযুদ্ধের এ চ্যাপ্টার থাকবে না। এটাকে বাদ দিয়েই হবে তাদের সবকিছু। ফলে আমাদের আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। আমাদের ভাইয়েরা তাদের অবস্থান একেবারে স্পষ্ট করেছেন। তাদের দীনটা সাবজেক্ট নয়, আর দীনটাই আমাদের সাবজেক্ট। এ জায়গায় এ ভাইয়দের সাথে আমাদের আদর্শিক পথ একেবারে আলাদা হয়ে গেলো। তারা একদিন আমাদের ভাই ছিলেন, আমাদের প্রিয় মানুষ ছিলেন। এখন আমরা কী করবো এ ভাইদেরকে? আমরা তাঁদের জন্যে দোয়া করবো। আল্লাহ যেন তাদেরকে দীনের পথে পরিপূর্ণভাবে ফিরায়ে আনেন।”

এটা শুনার পরে আমি এবি পার্টির সংবাদ সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তব্যটি পড়লাম। সেখানে লেখা আছে –

“১৫ ) বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য সংস্কৃতি এদেশের মানুষের মনেপ্রাণে প্রোথিত। নিজ ধর্ম নিয়ে হীনমন্যতা বা বাড়াবাড়ি কোনটাই এখানে গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের দেশের কৃষ্টি, সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি, উন্নয়ন সবকিছুতেই ধর্মের প্রভাব বিদ্যমান। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এদেশের প্রতিটি অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ধর্মীয় নেতৃত্বের একটি গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিল।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখানে ধর্মীয় দলগুলোর মাঝে মতাদর্শিক অনৈক্য খুবই প্রকট। নীতি ও মতভেদের কারণে একে অপরের বিরুদ্ধে ফতোয়া দেয়া, পরস্পরকে বাতিল মনে করা অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। নিজেকে একমাত্র সঠিক অন্যদের না-হক বা বাতিল মনে করার একদেশদর্শী চিন্তা বিপদজনক বিভাজনের জন্ম দেয়।
১৬ ) আমরা মনে করি মহান মুক্তিযুদ্ধ ও পবিত্র ধর্ম নিয়ে বাংলাদেশে সবচাইতে বেশি রাজনৈতিক অনৈক্য বিদ্যমান। মুক্তিযুদ্ধকে স্বীয় সম্পত্তি বা একক অর্জন মনে করে অন্যদের সবার অবদানকে অস্বীকার করা এবং গড়পড়তা সবাইকে দেশবিরোধী ভাবা স্পষ্ট হঠকারিতা ও স্বাধীনতার অঙ্গীকারের চরম লঙ্ঘন। অনুরূপভাবে নিজেদেরকে ধর্মের একমাত্র সোল এজেন্ট এবং বাকীদের পথভ্রষ্ট, নাস্তিক, বিপথগামী ও মুনাফেক ভাবা চরম অন্যায় ও অধার্মিকতা। এবি পার্টি ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধ কে সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে রেখে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করবে। আমরা বিশ্বাস করি দেশাত্মবোধ ও দেশপ্রেম, ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সকল ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর প্রতি সমান আচরণ এবং সামাজিক সুবিচার ও সাম্যের ভিত্তিতে একটি আধুনিক ও কল্যাণরাষ্ট্র গঠিত হলেই কেবল মানুষের মুক্তি মিলবে। তাই একটি আধুনিক জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই এবি পার্টির প্রধান লক্ষ্য। আর এ জন্য ৭ দফা কর্মসূচি আমরা প্রণয়ন করেছি যা আপনাদের সামনে আজ ঘোষণা করা হবে। “

জামায়াত নেতার বক্তব্যের সাথে এবি পার্টির নেতার বক্তব্যের মিল পেলাম না। এবি পার্টির বক্তব্যে ধর্মকে বাদ দেয়ার কথা বলা নেই। যাই হোক, এটা সমস্যা না। আসল সমস্যা হলো জামায়াত নেতার এ কথাটায় – “আল্লাহ যেন তাদেরকে দীনের পথে পরিপূর্ণভাবে ফিরায়ে আনেন।”

এ কথার দ্বারা বুঝা যায়, তিনি মনে করেন, যারা জামায়াতে ইসলাম থেকে বের হয়ে গেছেন, তারা ধর্ম বা দীন থেকেও বের হয়ে গেছেন। এখন তাই তিনি দোয়া করছেন, যাতে তারা আবার দীনে ফিরে আসেন। এখানেই সমস্যাটা।

নিজের দল থেকে বের হয়ে যাওয়াটাকে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাওয়া বলে প্রচার যে কেবল বাংলাদেশে হয়, তা নয়। তুরস্কেও এক সময়ে এ কথাগুলো খুব হচ্ছিলো। এরদোয়ান যখন এরবাকানের দল থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন, তখন এরবাকান এরদোয়ানকে ইসলাম থেকে বের করে দিতে অনেক বক্তব্য দিয়েছিলেন।

যেমন, এরবাকান বলেন –

“তায়িপ এরদোয়ান কাল কিয়ামাতের ময়দানে কীভাবে হিসাব দিবে? সে শুনে না থাকলে এখন শুনে নিক। সে বলতে পারে যে, ‘আমি ইমাম হাতিপ মাদ্রাসায় পড়েছি, আমার কোনো ভালো কাজ হারিয়ে যাবে না, আমি এর সম্পূর্ণ প্রতিদান আখিরাতে পাবো। আমার স্ত্রী পর্দানশীন, এর সম্পূর্ণ প্রতিদান আমি পাবো। আমি নিয়মিত নামাজ পড়ি, এর প্রতিদান আমি পাব। ‘ কিন্তু তুমি (এরদোয়ান) ইহুদিদের সমর্থন করেছো, তুমি ইসরাঈলকে সমর্থন করেছো। ইসরাঈল সুদ ও ক্যাপিটালিজম এর মাধ্যমে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশ আফ্রিকা মহাদেশ সবচেয়ে ফকির মহাদেশ হিসাবে পরিণত করেছে। এক মিলিয়ন মানুষকে খাদ্যহীনভাবে রেখেছে। ১০০ মিলিয়ন শিশুকে হত্যা করেছে। তুমি (এরদোয়ান) এই জুলুমের সমর্থন করার কারণে কাল কিয়ামত দিবসে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করবে? তখন হয়তো বলবে, ‘ইয়া রব্বি, আমি এ বিষয়গুলো এমন হবে জানতাম না’। এটা বলে তখন তুমি পার পাবে না।”


https://www.youtube.com/watch?v=NSsQ4A7T2FY

এরবাকান আরো বলেন –

“একে পার্টিকে ভোট দেয়া মানে ইসরাঈলকে ভোট দেয়া। একে পার্টিকে ভোট দেয়া মানে আমেরিকা ও আইএমএফকে ভোট দেয়া। …। এ নির্বাচনে ১০ টার মতো দল আছে। মিল্লিগুরুশ বা সাদাত পার্টি একদিকে আর অন্য সব দল আরেকদিকে। সাদাতপার্টি ছাড়া অন্য সব দল সুদপন্থী, সব দল আইএমএফপন্থী, সব দল আমেরিকাপন্থী, সব দল ইসরাঈলপন্থী। এদেরকে ভোট দিলে আপনি আরো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাহলে কী করতে হবে? একমাত্র সাদাতপার্টি-মিল্লিগুরুশ পার্টি রয়েছে, অন্য কোথাও গেলে আপনি মুক্তি পাবেন না। সাদাত পার্টিতে গেলে আপনি বিশাল এক রাস্তা পাবেন। “

দেখুন, এরবাকান নিজের দলকেই সত্যের একমাত্র মাপকাঠি ধরে নিয়ে বিপরীত মুসলিম দলগুলোকে ভ্রান্ত বানিয়ে দিয়েছেন। একই সমস্যা আমাদের দেশের সালাফী ও কওমীদের মধ্যেও আছে। তারা প্রত্যেকে নিজেদের দলকে একমাত্র হকপন্থী দল মনে করে বিপরীত সব দলকে ভ্রান্ত ও গোমরাহ মনে করে।

যে জামায়াতে ইসলাম এখন অন্যদেরকে গোমরাহ বলছে, সে জামায়াতকে দীর্ঘদিন থেকে কওমীরা গোমরাহ বলে আসছে, এবং সালাফীরা জামায়াতে ইসলামীকে খারেজি বলে আসছে। যে সালাফীরা এতদিন নিজেদেরকে সহীহ আকীদার লোক মনে করে এসেছে, সেই সহীহ আকীদার লোকজনকে জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা এখন চোর বলছে।

ব্যাপারটা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, যারা ফুটপাতে পণ্য বিক্রি করেন, তাঁরা বলেন, ‘আমার পণ্যটাই একমাত্র অরিজিনাল, এমন পণ্য সারা ঢাকা শহর ঘুরে আপনি পাবেন না।’ একইভাবে, যারা ইসলাম বিক্রি করেন, তাঁরাও বলেন, ‘আমার ইসলাম একমাত্র অরিজিনাল ইসলাম, এমন ইসলাম আপনি অন্য দলে পাবেন না।’

আরো পোস্ট

One Comment

  1. শুধু রাজনৈতিক দলই নয়, স্ব-স্ব ধর্মীয় মতের আলেমরাও নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ মনে করে এবং অন্যদেরক বাতিল মনে করে।
    আহলে হাদিসের এক আলেম আমাকে বলেছিলো তিনি হানাফিদের মুসলমান মনে করেন না।
    কি ভয়ঙ্কর কথা।

একটি মন্তব্য লিখুন

আপনার ইমেইল অ্যাড্রেস প্রকাশ করা হবে না। তারকা (*) চিহ্নিত ঘরগুলো পূরণ করা আবশ্যক