মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম – বুক রিভিউ
১) ধর্মনিরপেক্ষ একটি রাষ্ট্র কায়েমের জন্যে আমাদের দেশের কোনো মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেনি, বা শহীদ হয়নি; আমাদের দেশের মানুষ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন ইনসাফ ও সাম্য কায়েম করার জন্যে। এটি আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে।
২) বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধারা স্বেচ্ছায় কখনো ধর্মনিরপেক্ষ গ্রহণ করেনি, বরং ভারতের চাপে বাধ্য হয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতাশীলদের কেউ কেউ ধর্মনিরপেক্ষকে সাধারণ মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলমান সবার-ই ক্ষতি হয়েছে। যেমন, ১৯৭২ সালের আওয়ামী মন্ত্রীসভার একজন হিন্দু মন্ত্রী, ফণীভূষণ মজুমদার বলেন -“পাকিস্তান আমনে হিন্দুরা স্বাধীন সেক্যুলার বাংলাদেশের তুলনায় অনেক ভালো ছিলো। কারণ পাকিস্তান আমলে হিন্দুদের সংখ্যালঘু হিসেবে আইনতভাবে বিশেষ সুবিধা প্রদান করা হতো। কিন্তু বাংলাদেশের আমলে সেই বিশেষ অধিকার রহিত করা হয়, হিন্দুদেরকে এখন মুসলমানদের সঙ্গে সকল ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করতে হবে” [Shaukat Hassan, India-Bangladesh Political Relations during the Awami League Government, p – 77]
৩) আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কখনো ইসলাম বা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ছিলো না, বরং ইসলাম থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে। ইসলামের নামে যারা অপ-রাজনীতি ও জুলুম করেছে, তাদের বিরুদ্ধেই ছিলো আমাদের যুদ্ধ। অর্থাৎ, জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের যুদ্ধই হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ।
৪) সেক্যুলারদের বই-পুস্তকে, গল্প-উপন্যাস-কবিতা-ইতিহাসে, কিংবা চলচ্চিত্রে দেখানো হয় যে, রাজাকাররা সবাই ছিলো দাঁড়ি-টুপি-পাঞ্জাবি ওয়ালা মানুষ। অথচ বাস্তবতা তার ঠিক উল্টো। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দলীল প্রমাণে দেখা যায়, রাজাকারদের মুখে দাঁড়ি বা গায়ে টুপি-পাঞ্জাবি ছিলো না। বরং মাওলানা ভাসানীর মতো দাঁড়িওয়ালা এবং টুপি-পাঞ্জাবি পরা অসংখ্য আলেম-ওলামা নিজে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, অথবা মুক্তিযুদ্ধে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছেন। এ কারণে, অনেক আলেম পাকিস্তানি জালিম শাসকের বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে মুসলিমদের জন্যে জিহাদ বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
৫) যদিও ইসলামপন্থীদের মধ্যে খুবই ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী ইসলামের সঠিক নির্দেশনা না বুঝতে পেরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলো, কিন্তু অধিকাংশ ইসলামপন্থী মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে অবস্থান করেছিলো। বাংলাদেশে যেসব ইসলামপন্থী রাজনীতি করতে চায়, তাদেরকে এমন ইসলামপন্থীদের পথ অনুসরণ করতে হবে, যারা মুক্তিযুদ্ধে জালিমের বিরুদ্ধে ও বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন।
৬) পিনাকীর বইয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় লিখেছেন গৌতম Das। তার মতে, পাকিস্তান আন্দোলনটা ইসলামের নামে হলেও আসলে এটি ছিলো হিন্দু জমিদারদের থেকে নিজেদের জমি পাবার আন্দোলন। অর্থাৎ, পাকিস্তান আন্দোলনটা ছিলো অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। আবার, মুক্তিযুদ্ধটাও ছিলো অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। পাকিস্তান আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ, একে অপরের বিপরীত নয়, বরং একে অপরের ধারাবাহিকতা। পাকিস্তান আন্দোলন না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, যেমন কাশ্মীর এখনো স্বাধীন হতে পারছে না।
সবশেষে বলতে হয় যে, পিনাকী দাদার বইটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে।