আলেমদের কেন সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া উচিত নয়?
একটি সমাজে যারা জ্ঞান চর্চা করেন, যাদেরকে আমরা বুদ্ধিজীবী বা আলেম বলি, তারা রাজনীতিতে সরাসরি অংশ না নেওয়াটাই স্বাভাবিক। আলেম ও বুদ্ধিজীবীরা রাজনীতি ব্যক্তিদের পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করতে পারেন, কিন্তু সরাসরি রাজনীতি করতে চাইলে নানা বিপদ ঘটে।
আমরা জানি, একটি সমাজ অনেকে মানুষের সমন্বয়ে গড়ে উঠে। সমাজের কেউ হয় ডাক্তার, কেউ হয় ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু একজন ডাক্তার একইসাথে ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার হতে চাইলে, কোনোটিই ভালোভাবে সম্পাদনা করতে পারবেন না। একইভাবে একজন ব্যক্তি যখন জ্ঞানের চর্চা করেন, তখন তিনি মানুষের অধিকার আদায় বা রাজনীতি নিয়ে বেশি সময় দিতে পারেন না। কেউ যদি একই সাথে জ্ঞান অর্জন ও রাজনীতি দুটোই করতে চান, তাহলে কোনোটিই ভালোভাবে করতে পারেন না।
এ জন্যে আল্লাহ তায়ালা বলেন –
وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنفِرُواْ كَآفَّةً فَلَوْلاَ نَفَرَ مِن كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَآئِفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُواْ فِي الدِّينِ وَلِيُنذِرُواْ قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُواْ إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ
“আর সমস্ত মুমিনের অভিযানে বের হওয়া সঙ্গত নয়। তাই তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হলো না, যাতে দ্বীনের জ্ঞান লাভ করে এবং সংবাদ দান করে স্বজাতিকে, যখন তারা তাদের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে, যেন তারা বাঁচতে পারে। “[ সুরা তাওবা ৯:১২২ ]
এ আয়াতে স্পষ্ট যে, সকল মুমিন বান্দাকে একসাথে দেশরক্ষা বা ইসলামরক্ষার জন্যে বিদেশি শক্তির সাথে লড়া উচিত নয়, বরং কিছু লোকের কেবল জ্ঞান চর্চা করা উচিত, যারা অন্য বিপ্লবী লোকদের সতর্ক করতে পারে। অর্থাৎ, মুমিনদের একটি অংশ থাকবে তাত্ত্বিক আলোচনা নিয়ে, যাদেরকে এখন আমরা আলেম ও বুদ্ধিজীবী বলি এবং আরেকটি অংশ থাকবে তত্ত্ব বাস্তবায়নে, যাদেরকে আমরা এখন রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসাবে জানি। ফলে এ আয়াত থেকেই আলেম ও রাজনীতিবিদের একটি পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।
একটি হাদীসে আবু হূরায়রা রা বলেন, “লোকে বলে, আবূ হুরায়রা (রা) বড় বেশী হাদীস বর্ণনা করে। (জেনে রাখ,) কিতাবে দুটি আয়াত যদি না থাকত, তবে আমি একটি হাদিসও বর্ণনা করতাম না। আসলে আমার মুহাজির ভাইয়েরা বাজারে কেনাবেচায় এবং আমার আনসার ভাইয়েরা জমা-জমির কাজে মশগুল থাকত। আর আবূ হুরায়রা (রা) (খেয়ে না খেয়ে) তুষ্ট থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে লেগে থাকত। তাই তারা যখন উপস্থিত থাকত না, তখন সে উপস্থিত থাকত এবং তারা যা মুখস্থ করত না সে তা মুখস্থ রাখত।” (বুখারী, ইফা, ১১৯)
এ হাদীসে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই যে, সাহাবীদের মধ্যে যারা জ্ঞানের চর্চা করতেন, তারা ব্যবসা বা কৃষি কাজ করার সময় পেতেন না। আবার যারা রাজনীতি, যুদ্ধ, ব্যবসা বা অন্য কাজে যুক্ত ছিলেন, তারা জ্ঞান অর্জনের সময় পেতেন না।
খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা) ছিলেন বিশ্বসেরা সেনাপতি, কিন্তু জ্ঞানের দিক থেকে খুব সামান্যই জানতেন। তিনি যেহেতু সেনাপতি ছিলেন তাই তাকে অনেক সময় নামাজে ইমামতি করতে হতো। কিন্তু দেখা যেতো তিনি ছোট ছোট সূরাগুলো পর্যন্ত ভুল করতেন। তিনি সূরা আল-কাফিরুন খুব বেশি ভুল করতেন; কারণ সেখানে একই ধরনের কথা বার বার এসেছে। তিনি নামাজ শেষে সৈন্যদের দিকে ঘুরে বলতেন, ‘আমি জিহাদ দ্বারা এতো বেশি সম্পৃক্ত হয়ে গেছি যে, কুরআনের জ্ঞান অর্জন করতে পারিনি’।খালিদ (রা) একজন নেতা ছিলেন অথচ তিনি জ্ঞানী বলতে যা বুঝায় তা ছিলেন না। অন্যদিকে আবু যর (রা) জ্ঞানের দিক থেকে পরিপূর্ণ ছিলেন কিন্তু তিনি নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে অক্ষম ছিলেন। দেখুন https://cscsbd.com/842
এ কারণেই সম্ভবত সমাজবিজ্ঞানী ইবনে খালদুন বলেছিলেন,
“”আলেমগন বা জ্ঞানীগণ তাদের সার্বিক ধারনা ও এক বিষয়কে অনুমান করার যে অভ্যাস গড়ে তুলেছেন, তার ফলে তারা যখন রাজনীতিতে দৃষ্টি দেন, তখন তাকেও তারা তাদের সেই মননশীলতার ও যুক্তি-প্রমাণের কাঠামোতে ঢেলে সাজাতে চান, ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভ্রান্তিতে পড়েন ও অবিশ্বস্ত হয়ে ওঠেন। ” (মুকাদ্দিমা, ২য় খণ্ড, ৩৪৫)
মোদ্দা কথা হলো, আলেমদের রাজনীতি সচেতন হওয়া উচিত, তবে সরাসরি রাজনীতিতে অংশ নিতে চাইলে একজন ডাক্তারের ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যাবার মতো অবস্থা হবে।