| |

সখী, ভালোবাসা কারে কয়?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিখ্যাত একটি কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রশ্ন তুলছিলেন। তিনি প্রশ্ন করেন – সখী, ভালোবাসা কারে কয়? সে কি কেবলই যাতনাময়?

রবীন্দ্রনাথের কথা হলো, আকাশ-বাতাস, গাছগাছালি, সাগর-নদী, গ্রহ-তারা, চাঁদ-সূর্য, বিশ্বের সবাই ভালোবেসে সুখী হয়। কিন্তু মানুষ কেন ভালোবেসে যন্ত্রণা ভোগ করে? কেন ভালোবাসার যন্ত্রণায় মানুষ নিজে নিজে জ্বলে পুড়ে মরে যায়? কেন এ যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মানুষ আত্মহত্যা করে? কেন নিজের ভালোবাসার মানুষকে সে নিজেই হত্যা করে?

রবীন্দ্রনাথ এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পেয়েছিলেন কিনা জানি না। তবে আলোচ্য প্রবন্ধে আমরা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার চেষ্টা করব।

প্রথমত বোঝার চেষ্টা করি, ভালোবাসা কি? এর কি কোনো বস্তুগত সংজ্ঞা আছে?

উত্তর হলো – না। ভালোবাসার কোনো বস্তুগত সংজ্ঞা নেই। ভালোবাসাকে যিনি যেভাবে উপলব্ধি করেন, তিনি সেভাবে এর সংজ্ঞা নির্ধারণ করেন। ভালোবাসা পানির মত কোনো বস্তু নয় যে তার সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেয়া যায়, এটি হলো অনুভবের বিষয়। বস্তুর আকার, স্থান, কাল ও সীমানা থাকে; কিন্তু অনুভবের আকার, স্থান, কাল বা সীমানা থাকে না। অনুভব বস্তুর ঊর্ধ্বে। তাই ভালোবাসার বস্তুগত কোনো সংজ্ঞা দেয়া যায় না।

তাহলে ভালোবাসা কাকে বলে?

মহাবিশ্বে যা কিছু আছে, সবকিছু একটির সাথে অন্যটি সম্পর্কযুক্ত; তাই তারা সবাই একে অপরকে আকর্ষণ করে। মহাবিশ্বের একটি বস্তু অপর বস্তুকে যে মাধ্যম দ্বারা আকর্ষণ করে তার নাম ভালোবাসা। অর্থাৎ, ভালোবাসা এমন একটি অদৃশ্য শক্তি, যা দুই বা ততোধিক ব্যক্তি বা বস্তুর মধ্যে আকর্ষণ সৃষ্টি করে। অন্যভাবে বললে, ভালোবাসা এমন একটি অদৃশ্য সুতা, যা মহা বিশ্বের সব কিছুকে একই মালায় গেঁথে রাখে।

এখন প্রশ্ন হলো, মহাবিশ্বের সবাই কেন একে অপরকে আকর্ষণ করে অথবা কেন একে অপরকে ভালোবাসে? উত্তর হলো, মহাবিশ্বকে গতিশীল রাখার জন্যে। প্রশ্ন হলো, মহাবিশ্বকে গতিশীল রাখতে হবে কেন? উত্তর হলো, মহাবিশ্বে নতুন নতুন সৃষ্টি সংযুক্ত করার জন্যে, কিংবা মহাবিশ্বকে সমৃদ্ধ করার জন্যে।

সুতরাং, আমরা বলতে পারি, ভালোবাসা হলো এমন একটি অদৃশ্য শক্তির নাম, যা মহাবিশ্বে নতুন চেতনা, নতুন মানুষ বা নতুন বস্তু সৃষ্টি করার মধ্যমে মহাবিশ্বকে সমৃদ্ধ করে।

এই সংজ্ঞাটির সমর্থনে মহাবিশ্ব থেকে অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যায়। কিন্তু এখানে আমরা মানবজাতির প্রাত্যহিক জীবন থেকে একটি ছোট্ট উদাহরণ দিচ্ছি।

ধরুন, আপনি মার্কেটে গেলেন। একটা জামা দেখে আপনার খুব পছন্দ হয়েছে। এই জামাটা গায়ে দিলে লোকে আপনার প্রতি আকৃষ্ট হবে, কিংবা, লোকে আপনাকে ভালোবাসবে, এমনটা ভেবে আপনি জামাটা কিনে ফেললেন। এখানে ঘটনাটা তাহলে কি ঘটলো? প্রথমত আপনার নিজের প্রতি নিজের ভালোবাসা জন্মাল, তারপর সে ভালোবাসা দোকানের জামাটির প্রতি গেল, জামাটি আপনাকে আকর্ষণ করল, এবং আপনিও জামাটি কিনে নিলেন। ফলে দোকানদার এরকম আরও অনেক নতুন জামা তৈরি করার জন্যে গার্মেন্টসকে বললো। অর্থাৎ, আপনার মাঝে একটি অদৃশ্য ভালোবাসা কাজ করার কারণে অনেকগুলো নতুন জামা তৈরির ব্যবস্থা হল। এ ঘটনাটির আলোকে আমরা বলতে পারি, ভালোবাসা হলো সকল সৃষ্টির উৎস। আর স্রষ্টা হলেন ভালোবাসার উৎস। সহজ ভাষায় বললে, ভালোবাসার কারণেই সকল সৃষ্টির শুরু হয়। যেমন, নারী পুরুষের ভালোবাসার কারণে সন্তানের জন্ম হয়।

এখন আমাদের মনে যে প্রশ্নটি জাগা স্বাভাবিক, তা হলো, ভালোবাসার কি নিজস্ব কোনো সত্তা বা অস্তিত্ব আছে?

উত্তর হলো, হ্যাঁ। ভালোবাসার নিজস্ব একটি সত্তা আছে, কিন্তু আমারা তা দেখতে পারি না। কারণ, স্বয়ং ভালোবাসা বস্তু জগতের অনেক ঊর্ধ্বে অবস্থান করে।

এটা বোঝার জন্যে প্রথমত আমাদেরকে বৈশ্বিক চেতনার স্তরবিন্যাসটি জানা প্রয়োজন। বিশ্বজগতে যা কিছু আছে, সবকিছু কোনো না কোনো চেতনার স্তরে অবস্থান করে। পাথরের মত জড় বস্তুগুলো চেতনার একেবারে নিচের স্তরে অবস্থান করে; তাই আমরা পাথর ও বিভিন্ন বস্তুকে বলি নিষ্প্রাণ, নির্জীব বা অচেতন। পাথর থেকে কিছুটা উপরের চেতনায় অবস্থান করে গাছপালা, তাই আমরা বলি, গাছেরও প্রাণ আছে। অর্থাৎ, প্রাণীদের মত গাছের কোনো হৃদয় না থাকলেও তাদের প্রাণ আছে। বিভিন্ন পশুপাখিরা গাছের চেয়েও উন্নত চেতনার স্তরে অবস্থান করে, কারণ তাদের শরীরে একটি হৃদয় আছে। পশুপাখিদের চেয়েও উন্নত চেতনার স্তরে অবস্থান করে মানুষ, কারণ তারা মুখের সাহায্যে তাদের হৃদয়ের ভাষা প্রকাশ করতে পারে। এভাবে মানুষের চেয়ে অনেক উপরের চেতনায় অবস্থান করে স্বয়ং অদৃশ্য ভালোবাসা।

একটি উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি আরো ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করি। ধরুন, আম গাছে একটি আম বড় হচ্ছিল। আপনি গাছ থেকে আমটি নিয়ে খেয়ে ফেললেন। তখন আমটির ক্ষুদ্র চেতনা শক্তি আপনার ভিতরে এসে বৃহৎ চেতনা শক্তিতে রূপান্তরিত হলো। অর্থাৎ, আমটি ছোট চেতনা থেকে আরেকটু বড় চেতনায় প্রবেশ করল। এভাবে, মানুষের চেতনা যখন বস্তুগত চেতনার ঊর্ধ্বে উঠতে পারে, তখন সে চেতনা ভালোবাসা নামক স্তরে পৌঁছাতে পারে।

এ বিষয়টিকে আমরা আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যেও বুঝতে পারি। আধুনিক বিজ্ঞান ও কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এ ‘স্ট্রিং তত্ত্ব’ নামে একটি সূত্র আছে। এই সূত্রটির মাধ্যমে বিশ্বের সবকিছুকে বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। ‘স্ট্রিং’ হলো এমন একটি অদৃশ্য জিনিসের নাম, যা দ্বারা বিশ্বের সবকিছু গঠিত হয়। অর্থাৎ, আলো, বাতাস, শব্দ, তরঙ্গ, বস্তু – সবকিছুই এই অতি ক্ষুদ্র ‘স্ট্রিং’ নামক একক দ্বারা গঠিত। ভালোবাসাকেও এই স্ট্রিং দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়। ‘স্ট্রিং তত্ত্ব’ অনুযায়ী, ভালোবাসার-ও একটি স্বতন্ত্র স্ট্রিং সত্তা রয়েছে। ভালোবাসার স্ট্রিং কাঠামো এক রকম, আর মানুষের স্ট্রিং কাঠামো অন্য রকম। তবে দুটি স্ট্রিং একই প্রকৃতির।

বৈজ্ঞানিক এ তত্ত্বটিকে আরেকটু সহজ ভাষায় বলি। কঠিন, তরল ও বায়বীয় পদার্থের মত ভালোবাসাও একটি নিজস্ব সত্তা বা অস্তিত্ব রয়েছে। ভালোবাসা যখন নিম্ন চেতনার স্তরে নেমে আসে তখন সেটি বায়বীয়, তরল ও কঠিন পদার্থে রূপ নেয়। অন্যদিকে, কঠিন, তরল ও বায়বীয় পদার্থগুলো যখন তাদের নিজেদের চেতনার স্তর অতিক্রম করতে পারে, তখন তারা ভালোবাসার স্তরে পৌঁছাতে পারে।

______

এবার রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় প্রশ্নে আসি। তিনি বলেন, ভালোবাসা সে কি কেবলই যাতনাময়? বিশ্বের সকল সৃষ্টি ভালোবেসে সুখী হয়, কিন্তু মানুষ কেন ভালোবেসে যন্ত্রণা পায়?

এর এক কথায় উত্তর হচ্ছে, মানুষ যখন ভালোবাসাকে চিনতে ভুল করে, অথবা, মানুষ যখন ভালোবাসা ও যন্ত্রণাকে পৃথক করতে পারে না, তখন তার কাছে মনে হয় – ‘ভালোবাসার অপর নাম যন্ত্রণা’।

এটি বোঝার জন্যে প্রথমে আসুন, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ এ কথাটি বোঝার চেষ্টা করি। এ বাক্যে তিনটি শব্দ আছে ‘আমি’ ‘তুমি’ ও ‘ভালোবাসা’। যারা এ তিনটি শব্দকে ভালোভাবে বুঝতে পারেন, তাদের ভালোবাসা সবসময় সুখের হয়। কিন্তু যারা এ তিনটি শব্দকে বুঝতে পারেন না, তাদের ভালোবাসা যন্ত্রণায় রূপ নেয়।

‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ –এ বাক্যে ‘আমি’ ও ‘তুমি’ শব্দ দুটি হলো সর্বনাম। কিন্তু ‘ভালোবাসা’ শব্দটি হলো ক্রিয়া। তাই, শাব্দিকভাবেই ‘আমি’ ও ‘তুমি’ শব্দ দুটি থেকে ‘ভালোবাসা’ শব্দটি সম্পূর্ণ আলাদা। এ বাক্যে ‘ভালোবাসা’ হলো এমন একটি শব্দ যা ‘আমি’ ও ‘তুমি’ শব্দ দুটির মাঝে সম্পর্ক সৃষ্টি করে। এখানে ‘আমি’ ও ‘তুমি’ হলো দুটি বস্তুবাচক শব্দ; কিন্তু ‘ভালোবাসা’ হলো একটি অদৃশ্য শক্তির নাম।

সুতরাং, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ –এ বাক্যের অর্থ হলো, “আমি ও তুমি, আমরা পরস্পর পৃথক দুটি সত্তা ভালোবাসা নামক এক অদৃশ্য শক্তির সাহায্যে পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করছি”।

মানুষ যখন ভালোবাসার এ সত্যটি বুঝতে পারেন, তখন তার কাছে মনে হয়, ভালোবাসা এক মহাসুখের নাম। কিন্তু মানুষ যখন এ সত্যটি বুঝতে পারেন না, তখনি কেবল তার মনে হয়, ভালোবাসার অপর নাম যন্ত্রণা।

আমরা সাধারণত বলি – “তুমি আমার ভালোবাসা”। এখানে এই ‘তুমি’-কে যদি বস্তুগত বৈশিষ্ট্যের ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়া যায়, তখন তার নাম হয় ভালোবাসা। আর এই ভালোবাসা-ই অফুরন্ত সুখ বয়ে আনে, যার নাম জান্নাত। কিন্তু, এর বিপরীতে ‘ভালোবাসা’কে যদি ‘তুমি’র স্তরে নিয়ে আসা হয়, তখন সে ভালোবাসার নাম হয় যন্ত্রণা বা জাহান্নাম।

আসুন, একটি ত্রিভুজ চিত্রের সাহায্যে বিষয়টি সহজে বোঝার চেষ্টা করি।love

চিত্রে ‘আমি’ ও ‘তুমি’ পরস্পর পৃথক দুটি নিম্ন বিন্দুতে অবস্থান করছে। আর, ‘ভালোবাসা’ অনেক উপরের একটি বিন্দুতে অবস্থান করছে। এখানে ‘আমি’ ও ‘তুমি’র মাঝে দুটি উপায়ে সম্পর্ক সৃষ্টি করা সম্ভব। প্রথমত, ‘আমি’ ও ‘তুমি’ উভয়ে নিজেদের স্ব স্ব বস্তুগত স্তর ও বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে উভয়ের মাঝে সম্পর্ক সৃষ্টি করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত, ‘আমি’ ও ‘তুমি’ উভয়ে নিজেদের স্ব স্ব বস্তুগত স্তর ও বৈশিষ্ট্য ত্যাগ করে ‘ভালোবাসা’র কাছে গিয়ে এক বিন্দুতে মিলিত হওয়া সম্ভব। যারা প্রথম উপায়ে সম্পর্ক সৃষ্টি করে, তাদের সম্পর্ক হয় দূরত্বের এবং যন্ত্রণার। কিন্তু যারা দ্বিতীয় উপায়ে সম্পর্ক সৃষ্টি করে, তাঁদের সম্পর্ক হয় অন্তরঙ্গ ও অফুরন্ত সুখের।

অর্থাৎ, ‘আমি’ ও ‘তুমি’, উভয়ে যখন নিজেদের বস্তুগত স্তর ও বৈশিষ্ট্য অতিক্রম করে ভালোবাসার স্তরে পৌঁছে যেতে পারে, তখন তারা উভয়েই প্রকৃত ভালোবাসাকে দেখতে পায়। এবং এ ভালোবাসা উভয়ের জন্যই এক অফুরন্ত সুখ বয়ে আনে। কিন্তু উভয়ে যদি ‘ভালোবাসা’কে নিজেদের বস্তুগত স্তরে নিয়ে আসতে চায়, তাহলে ‘ভালোবাসা’ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। তখন সে ভালোবাসা আর ভালোবাসা থাকে না, তার নাম হয়ে যায় যন্ত্রণা।

আরেকটু সহজভাবে বলি। আমাদের ব্যক্তিগত চেতনা যতবেশি বস্তু নির্ভর হয়ে যায়, আমরা ততবেশি ভালোবাসা থেকে দূরে সরে যাই। আর আমাদের চেতনা যত বেশি আধ্যাত্মিক হয়, আমরা ততবেশি ভালোবাসার নিকটবর্তী হই। অন্যভাবে বললে, আমরা যতবেশি বস্তুকে প্রাধান্য দিব, আমাদের ভালোবাসা ততবেশি সংকোচিত হবে। আর, আমরা বস্তুকে যত কম প্রাধান্য দিব, আমাদের ভালোবাসার পরিধি ততবড় হতে থাকবে।

এবার আসুন কিছু কেইস স্টাডি করি।

পত্র পত্রিকা বা টেলিভিশনে আমরা প্রতিনিয়ত দেখি, খাদিজারা প্রেমের প্রস্তাব কবুল না করলে ক্ষমতাশীল বদরুলেরা খাদিজাদেরকে চাপাতি দিয়ে কোপাতে থাকে। প্রথম আলো’রা প্রায় লিখে – “বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার সুরভী আকতার নামের এক কলেজছাত্রীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে যমুনার দুর্গম চরে বেড়াতে নিয়ে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে”। ফেইবুকে পরকীয়া করার অভিযোগে রুমানার মত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকাদের চোখ তুলে নেয় তাদের আধুনিক শিক্ষিত স্বামীরা। তাহসান-মিথিলার মত ‘ভালোবাসা’র শিক্ষক ও তারকারা নিয়মিত-ই জ্বলে-পুড়ে ঘর ভাঙছেন নিজেদের।

এমন হাজারো ঘটনা আমাদের চোখের সামনে ঘটে চলছে নিয়মিত। প্রশ্ন হলো, ভালোবাসার নামে এসব ভয়ঙ্কর ঘটনাগুলো কেন ঘটছে?

সাইদ ও রোমানার ঘটনাটি একটু বিশ্লেষণ করুন। বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ার সাইদ ভালোবেসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রুমানাকে বিয়ে করেন। দু’জন-ই আধুনিক বস্তুবাদী শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত। সাইদ মনে করলেন, ভালোবাসা মানে হলো রুমানা, কিন্তু রোমানা হলেন একটি বস্তু । এখানে, ‘রুমানা’ ও ‘ভালোবাসা’ –এ দুয়ের মাঝে কোনো পার্থক্য করতে পারেননি সাইদ। রুমানা মাটির মানুষ বলে তার যে একটি বস্তুগত চেতনা আছে, এবং ভালোবাসার যে বস্তুজগতের ঊর্ধ্বে এক অদৃশ্য শক্তির নাম, সেটা পার্থক্য করতে পারলে সাইদ এতটা হিংস্র হতেন না। বস্তুবাদী সাইদ ভালোবাসাকে রুমানার শরীর ও ইচ্ছার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলেন। ফলে, তিনি রুমানার চোখ ও শরীর থেকে ভালোবাসা আদায় করতে চেষ্টা করেন, এবং রুমানার শরীরের উপর নির্যাতন শুরু করেন। কিন্তু, সাইদ যদি ‘ভালোবাসা’কে রুমানার স্তরে না নিয়ে এসে, বরং রুমানাকে ভালোবাসার স্তরে নিয়ে যেতে পারতেন, তাহলে রুমানার অনুপস্থিতে সাইদ নিজেকে ভালোবাসা বঞ্চিত মনে করতেন না। এবং সাইদ এতটা ভয়ঙ্কর ও হিংস্র হতেন না।

যাই হোক, উপসংহারে চলে আসি।

ভালোবাসা নিজের আলাদা একটি বৈশ্বিক অস্তিত্ব রয়েছে। বৈশ্বিক ভালোবাসাকে আমরা যত বেশি গ্রহণ করতে পারি, আমরা তত বেশি ভালো ও দয়ালু হয়ে উঠি। আর বৈশ্বিক ভালোবাসার সীমানা থেকে আমরা যত বেশি দূরে সরে যাই, আমরা তত বেশি খারাপ ও হিংস্র হয়ে উঠি।

বস্তু হলো ভালোবাসার প্রকাশ্য ও সীমিত রূপ। এবং, ভালোবাসা হলো বস্তুর উহ্য ও অসীম রূপ। সীমিতকে পাওয়ার জন্যে অসীমকে ভুলে গেলে, ভালোবাসা তখন যন্ত্রণা হয়ে দেখা দেয়। কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে ভালোবাসা যায় না, ভালোবাসতে হয় স্বয়ং ভালোবাসাকে। তাহলে সেই ভালোবাসার নাম হয় সুখ। স্বয়ং ভালোবাসাকে না ভালোবেসে, ব্যক্তি বা বস্তুকে ভালোবাসলে তার নাম হয় যন্ত্রণা।

ভালোবাসা অসীম। পৃথিবীর সকল স্থানে ভালোবাসা ছড়িয়ে থাকে। ভালোবাসাকে কোনো একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা বস্তুর মাঝে সীমাবদ্ধ করে ফেললে, সে ভালোবাসা মারা যায়। ভালোবাসা তখন যন্ত্রণায় পরিণত হয়। আমরা অধিকাংশ সময়ে অপাত্রে ভালোবাসা প্রদান করি, তাই আমাদের ভালোবাসা নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের পরিবার, পথ শিশু, এতিম, চাকর-চাকরানী, দুর্বল মানুষ ও আমাদের অধীনস্থরা সব সময় আমাদের থেকে ভালোবাসা পাবার জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকে। আমরা তাঁদের মাঝে ভালোবাসার বীজ বপন না করে নষ্ট জমিতে ভালোবাসার চারা লাগাই। ফলে যত কষ্ট করেই ভালোবাসার চারা রোপণ করি না কেন, দিনশেষে সব নষ্ট হয়ে যায়। তখন আমরা বলতে শুরু করি, ‘ভালোবাসার অপর নাম যন্ত্রণা’।

সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান ও জ্যামিতির মাধ্যমে ভালোবাসা বোঝার পর, এবার আমরা ধর্মের সাহায্যে ভালোবাসাকে বোঝার চেষ্টা করব।

আল্লাহ হলেন সকল ভালোবাসার উৎস। তাই আল্লাহকেই কেবল ভালোবাসা যায়। আল্লাহর কারণেই একজন মানুষ অন্য মানুষকে ভালোবাসতে পারে। আল্লাহর কারণেই প্রেমিক তার প্রেমিকাকে ভালোবাসে, স্বামী তার স্ত্রীকে ভালোবাসে, পিতা-মাতা তার সন্তানকে ভালোবাসে, এবং সন্তান তার বাবা-মাকে ভালোবাসে। আল্লাহর কারণেই মানুষ পশুপাখিকে ভালোবাসে, এবং পশুপাখিও মানুষকে ভালোবাসে। আল্লাহর কারণেই বিশ্বের সকল বস্তু একে অপরকে আকর্ষণ করে এবং ভালোবাসে।

আল্লাহর ভালোবাসা ব্যতীত কোনো ব্যক্তি বা বস্তুই একে অপরকে আকর্ষণ করতে পারে না, এবং একে অপরকে ভালোবাসতে পারে না। মহাবিশ্বের সকল প্রাণী ও বস্তুগুলো একে অপরকে আকর্ষণ করার এবং ভালোবাসার শক্তি কেবল আল্লাহ তায়ালাই দান করেন। সুতরাং, যে কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে ভালোবাসতে হয় কেবল আল্লাহর কারণেই। মানুষ ব্যতীত বিশ্বের সকলেই আল্লাহর এই ভালোবাসাকে সঠিকভাবে বুঝতে পারেন, তাই তারা পরস্পরকে ভালোবেসে কখনো দুঃখ পায় না। কিন্তু মানুষ ভালোবাসার এই সত্যটি বুঝতে না পারার কারণে একে অপরকে ভালোবেসে কেবল দুঃখ ও যন্ত্রণা অনুভব করে।

ভালোবাসা বিষয়ে কোর’আনের আরও অসংখ্য আয়াত আছে। যেমন – [২: ১৬৫], [ ৭৬: ৮], [৯: ২৪], [৩: ১৪], [২: ১০৭], [২: ১৭৭]। কোর’আনের এ সমস্ত আয়াত পড়লে তখন আর আমাদেরকে রবীন্দ্রনাথের মত আর প্রশ্ন করতে হবে না – সখী, ভালোবাসা কারে কয়? সে কি কেবলই যাতনাময়?

যেমন, আল্লাহ তায়ালা বলেন –

وَمِنَ النَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ اللَّهِ أَندَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِّلَّهِ وَلَوْ يَرَى الَّذِينَ ظَلَمُوا إِذْ يَرَوْنَ الْعَذَابَ أَنَّ الْقُوَّةَ لِلَّهِ جَمِيعًا وَأَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعَذَابِ

“এমন কিছু মানুষ রয়েছে, যারা আল্লাহ তায়ালাকে ব্যতীত অন্য ব্যক্তি বা বস্তুকে তাদের ভালোবাসার সম্বল হিসাবে গ্রহণ করে। তারা আল্লাহকে ভালোবাসার মতই সেগুলোকে ভালোবাসে। কিন্তু যারা ঈমান এনেছে, তাঁরা আল্লাহকে সবকিছু থেকে বেশি ভালোবাসে। জালিমরা যে যন্ত্রণা পাবে, তা যদি তারা এখন বুঝতে পারতো, হায়! সমস্ত ক্ষমতা আল্লাহর-ই; নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা যন্ত্রণা প্রদানে খুবই কঠোর। [সূরা ২/বাকারা – ১৬৫]

অর্থাৎ, আল্লাহ ছাড়া কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে ভালোবাসা যায় না। আল্লাহ ছাড়া যেই ভালোবাসা, তার নাম যন্ত্রণা বা জাহান্নাম। অন্যদিকে, আল্লাহকে ভালোবাসার নাম অফুরন্ত সুখ বা জান্নাত। মানুষ ব্যতীত বিশ্বের সকল দৃশ্য ও অদৃশ্য কণিকা আল্লাহকে ভালোবাসে, তাই তারা অফুরন্ত সুখ অনুভব করে। কিন্তু মানুষ ভালোবাসার নামে বস্তুবাদকে গ্রহণ করে, তাই সে অসহ্য যন্ত্রণায় ভোগ করতে থাকে।

আরো পোস্ট

একটি মন্তব্য লিখুন

আপনার ইমেইল অ্যাড্রেস প্রকাশ করা হবে না। তারকা (*) চিহ্নিত ঘরগুলো পূরণ করা আবশ্যক