|

দাওয়াতি কাজের জন্যে কোন পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত? মসজিদ মডেল নাকি মার্কেট মডেল?

ইসলামে দাওয়াত দেয়া ফরজে কিফায়া। অবশ্যই সমাজের কাউকে না কাউকে এ কাজ করতে হবে। ইবনে খালদুনের মতে, একক কাজ করার চেয়ে সংগঠিতভাবে কাজ করার ফল বেশি। কিন্তু সংগঠিতভাবে কাজ করতে গেলে নানা জটিলতার তৈরি হয়। এক সংগঠন নিজের দাওয়াতের যৌক্তিকতা তুলে ধরার জন্যে অন্য দাওয়াতি সংগঠনকে ভ্রান্ত বলেন। এ থেকে মুক্তির একটি উপায় হলো ‘মসজিদ মডেল’ ফলো করা।

‘মসজিদ মডেল’ কি?

১) পৃথিবীর সকল মুসলিমের নামাজ পড়ার জন্যে যেমন অসংখ্য মসজিদ প্রয়োজন, তেমনি মুসলিমদের দাওয়াতি কাজ করার জন্যে অসংখ্য সংগঠন প্রয়োজন।

২) পৃথিবীর একটি মসজিদ যেমন অপর মসজিদকে খারাপ বলে না, তেমনি মুসলিমদের কোনো দাওয়াতি সংগঠন-ই অন্য সংগঠনকে খারাপ বলবে না।

৩) প্রতিটি মসজিদ যেমন তাদের মুসল্লিদের জন্যে মসজিদের সৌন্দর্য ও সুবিধা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করে, তেমনি প্রতিটি দাওয়াতি সংগঠন তাদের নিজেদের সৌন্দর্য, সুবিধা ও সেবা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করবে।

৪) একজন মুসলিম যেমন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ইচ্ছে করলে পাঁচটি মসজিদে গিয়ে পড়তে পারে, তেমনি কেউ ইচ্ছা করলে একইসাথে অনেক সংগঠনে কাজ করতে পারবে।

৫) কোনো মসজিদে প্রবেশ করতে এবং বের হয়ে যেতে যেমন কারো কাছে কৈফিয়ত দিতে হয় না, তেমনি কোনো দাওয়াতি সংগঠনে প্রবেশ করতে বা ঐ সংগঠন থেকে বের হয়ে যেতে কারো কাছে কৈফিয়ত দেয়ার প্রয়োজন যেন না হয়।

৬) কোনো মসজিদে যদি ইমাম না থাকে, তাহলে যেমন মুসল্লিদের একজন নামাজের ইমামতি করতে পারে; তেমনি নতুন কোনো দাওয়াতি কাজে অন্য কাউকে আমীর বা নেতা হিসাবে না পেলে নিজেই সংগঠন সৃষ্টি করতে পারে।

৭) মসজিদের উন্নয়নের জন্যে যেমন মানুষের কাছে টাকা চাওয়া হয়, তেমনি কোনো সংগঠনের উন্নয়নের জন্যে মানুষের কাজে টাকা চাওয়া যায়। তবে কোনোভাবেই টাকা বা চাঁদার জন্যে মানসিক চাপ দেয়া যাবে না। কেউ ইচ্ছা হলে দিবে, ইচ্ছা না হলে দিবে না টাকা।

৮) মসজিদে সকল মুসল্লি যেমন সমান গুরুত্ব পায়, তেমনি দাওয়াতি সংগঠনে সকল মুসলিম সমান গুরুত্ব পাবে। দাওয়াতি সংগঠনে কোনো ক্যাডার সিস্টেম বা বিভিন্ন মর্যাদার মানুষ থাকবে না, সবাই সমান মর্যাদার অধিকারী হবেন।

৯) মসজিদে যেমন নারী ও পুরুষ সকলের প্রবেশের ও একসাথে নামাজ পড়ার অধিকার আছে, তেমনি দাওয়াতি সংগঠনগুলোতে নারী ও পুরুষ একত্রে দাওয়াতি কাজ করতে পারবে।

১০) কোনো মসজিদ যদি নির্মাণ হয় মুমিনদের মাঝে বিভক্তি তৈরির জন্যে, তাহলে সে মসজিদে নামাজ পড়া উচিত নয়। (সূত্র: কুরআন ৯/১০৮)। কোন ইসলামি দল বা গ্রুপ যদি সৃষ্টি হয় মুসলিমদের মাঝে বিভক্তি তৈরির জন্যে, তাহলে সে দল বা গ্রুপে যুক্ত হওয়া উচিত নয়।

যদি আমরা আমাদের দাওয়াতি সংগঠনগুলোকে ভার্চুয়াল মসজিদ মডেলে সাজাতে পারি, তাহলে মুসলিমদের মাঝে ঝগড়া, দ্বন্দ্ব ও কোন্দল অনেকাংশে কমে যাবে।

দুর্ভাগ্য হলেও সত্য, বর্তমানে বিভিন্ন ইসলামি দল বা গোষ্ঠী ‘মসজিদ মডেল’ অনুসরণ না করে ‘মার্কেট মডেল’ অনুসরণ করছে।

এখানে ‘মার্কেট মডেল’ ও ‘মসজিদ মডেল’ মানে হচ্ছে:

১) একটি গ্রাম বা শহরেও যেমন অনেক মসজিদ থাকে, তেমনি মার্কেটে অনেক দোকান থাকে।

২) মসজিদগুলো একে অপরকে নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে না। কিন্তু মার্কেটে একটি দোকান একই ধরনের অন্য দোকানকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে।

৩) এক দোকানের মালিক তার কাস্টমারকে অন্য দোকানে যেতে দেয় না। কিন্তু এক মসজিদে নামাজ না পড়ে অন্য মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়াকে কেউ খারাপভাবে দেখে না।

৪) প্রত্যেক দোকানে নিজের পণ্যকে সেরা পণ্য হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো মসজিদ অন্য মসজিদ থেকে সেরা প্রমাণের চেষ্টা করে না।

৫) দোকানে দুনিয়াবি স্বার্থ থাকে, কিন্তু মসজিদে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে মানুষ যায়।

আমরা যদি বিভিন্ন ইসলামি দল ও গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ে গবেষণা বা চিন্তা করি, তাহলে দেখতে পাবো, তারা মসজিদ মডেলকে ফলো না করে, মার্কেট মডেলকে ফলো করছে। এ জন্যেই একটি ইসলামী দলের সাথে অন্য একটি ইসলামী দলের ঝগড়া লেগে থাকে। যারা সমস্ত মুসলিমকে নিজের দলের লোক মনে না করে, ধর্মীয়ভাবে বিভক্ত হয়ে আলাদা দল গঠন করে, তাদের সাথে সম্পর্ক রাখা উচিত নয়। আল্লাহ বলেন:

إِنَّ الَّذِينَ فَرَّقُواْ دِينَهُمْ وَكَانُواْ شِيَعًا لَّسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ

“নিশ্চয় যারা স্বীয় ধর্মকে খণ্ড-বিখণ্ড করেছে এবং অনেক দল হয়ে গেছে, তাদের সাথে আপনার কোন সম্পর্ক নেই।” [আল কুরআন ৬:১৫৯]

আমাদের জানা প্রয়োজন, ইসলামী সভ্যতার কেন্দ্র হলো মসজিদ, আর পশ্চিমা সভ্যতার কেন্দ্র হলো মার্কেট। মসজিদ থেকে আমাদের মাদানিয়াত বা সভ্যতা হয়েছে। আর পশ্চিমে সিটি থেকে সিটিজেন হয়েছে। ইসলামী দলগুলো যদি তাদের ‘মার্কেট মডেল’টা ফেলে দিয়ে ‘মসজিদ মডেল’টা গ্রহণ করে, তখন তারা আবার মুসলিমরা সভ্যতা নির্মাণ করতে পারবে।

আরো পোস্ট