ইমাম হাতিপ কী? ইমাম হাতিপে কি পড়ানো হয়?
তুরস্কের সরকারী মাদ্রাসার নাম ‘ইমাম হাতিপ’। ইমাম মানে তো আমরা সবাই বুঝি, মসজিদের ইমাম বা সমাজের নেতা। আর, হাতিপ শব্দটি আরবি খতিব শব্দ থেকে এসেছে। তার্কিশরা “খ” অক্ষরকে “হ” দিয়ে উচ্চারণ করে, এবং “ব” অক্ষরকে “প” অক্ষর দিয়ে উচ্চারণ করে। যেমন, “কিতাব” শব্দটিকে তারা বলে “কিতাপ”; বাজার শব্দটিকে তারা বলে “পাজার”; “ইবনে খালদুন”কে তারা বলে “ইবনে হালদুন”। এ কারণে “খতিব”কে তারা বলে “হাতিপ”।
যাই হোক, ইমাম হাতিপ মাদ্রাসায় সমাজের নেতা ও মসজিদের ইমাম বানানো হয় বলে এই মাদ্রাসাকে ‘ইমাম হাতিপ’ বলা হয়। তুরস্কে বর্তমান রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান সহ সরকারের অনেক নেতাই এই ইমাম হাতিপ মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। বলা চলে, তুরস্কের ইমাম হাতিপ সরকারী মাদ্রাসাটি আসলেই তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, ইমাম হাতিপ মাদ্রাসায় কী পড়ানো হয়?
অনেকে ভাবতে পারেন, যেহেতু ইমাম হাতিপ মাদ্রাসার কাজ হলো মসজিদের ইমাম বানানো, তাই এখানে কেবল কোর’আন-হাদিস পড়ালেই যথেষ্ট। আসলে কিন্তু বিষয়টা এমন নয়। ইমাম হাতিপ মাদ্রাসায় সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি পড়ানো হয়, তার নাম – গণিত। ধরুন, সপ্তাহে ২ ঘণ্টা যদি মসজিদের খুতবা দেয়া শেখানো হয়, তাহলে গণিত শেখানো হয় সপ্তাহে (৬+২) মোট ৮ ঘণ্টা।
ইমাম হাতিপ মাদ্রাসায় এক সপ্তাহে কোনো বিষয় কতটুকু পড়ানো হয়, তার একটা ধারণা দিচ্ছি।
৯ম-১০ম শ্রেণী।
গণিত – ৬ ঘণ্টা
গণিতের ইতিহাস – ২ ঘণ্টা
সাহিত্য – ৫ ঘণ্টা
কোর’আন – ৪ ঘণ্টা
হাদিস – ২ ঘণ্টা
সিরাত বা রাসূলের জীবনী – ২ ঘণ্টা
ফিকাহ – ২ ঘণ্টা
দর্শন – ২ ঘণ্টা
পদার্থ – ২ ঘণ্টা
জীববিজ্ঞান – ২ ঘণ্টা
রসায়ন – ২ ঘণ্টা
আরবি – ২ ঘণ্টা
ইংরেজি – ২ ঘণ্টা
ইতিহাস – ২ ঘণ্টা
ভূগোল – ২ ঘণ্টা
শারীরিক শিক্ষা ও খেলাধুলা – ১ ঘণ্টা
আমাদের দেশের আলীয়া মাদ্রাসায় নবম ও দশম শ্রেণীতে বিজ্ঞান ও মানবিক দুটি শাখা রয়েছে। পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান এসব পড়ানো হয় বিজ্ঞান শাখার শিক্ষার্থীদের, এবং ইতিহাস, ভূগোল, ফিকাহ এগুলো পড়ানো হয় মানবিক শাখার শিক্ষার্থীদের।
তুরস্কের সরকারী মাদ্রাসায় নবম-দশম শ্রেণীতে বিজ্ঞান ও মানবিক এমন দুটি শাখা নেই। নবম-দশম শ্রেণীর সকল শিক্ষার্থীকেই পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল পড়তে হয়। বাংলাদেশের আলীয়া মাদ্রাসার নবম-দশম শ্রেণীতে দর্শন, সিরাত ও খেলাধুলা নামক কোনো বিষয় নেই। কিন্তু, তার্কির মাদ্রাসায় এসব রয়েছে।
বাংলাদেশের আলীয়া মাদ্রাসার মতো কওমী মাদ্রাসাতে হাদিসের বিষয় থাকলেও সিরাত নিয়ে কোনো বিষয় নেই। তার্কিতে আছে।
এবার আসুন, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে কী পড়ানো হয়, তা একটু দেখি। ইন্টারে বা একাদশ শ্রেণিতে উঠলে তখন বিজ্ঞান ও মানবিক শাখা আলাদা করা হয়। কিছু বিষয় সকল শিক্ষার্থীদের পড়তে হয়। সেগুলো হলো –
গণিত – ৫ ঘণ্টা
সাহিত্য – ৫ ঘণ্টা
কোর’আন – ৩ ঘণ্টা
তাফসীর – ২ ঘণ্টা
নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ বা খুতবা – ২ ঘণ্টা
আকাইদ – ১ ঘণ্টা
ইতিহাস – ২ ঘণ্টা
দর্শন – ২ ঘণ্টা
ব্যবহারিক আরবি – ২ ঘণ্টা
ইংরেজি – ২ ঘণ্টা
শারীরিক শিক্ষা ও খেলাধুলা – ১ ঘণ্টা
বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত পড়ে –
পদার্থ – ৪ ঘণ্টা
রসায়ন – ৪ ঘণ্টা
জীববিজ্ঞান – ৪ ঘণ্টা
মানবিক শাখার শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত পড়ে –
মনোবিজ্ঞান – ২ ঘণ্টা
মানতিক – ২ ঘণ্টা
সমাজবিজ্ঞান – ২ ঘণ্টা
উসমানী ভাষা – ১ ঘণ্টা
সাহিত্য – ২ ঘণ্টা
এখানে কয়েকটি দেখার বিষয় রয়েছে। ইমাম হাতিপ মাদ্রাসার একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান পড়ুক, অথবা মানবিক শাখায় পড়ুক, সবাইকে ইতিহাস ও দর্শন পড়তে হয়, এবং নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ নিতে হয়।
ইতিহাস পড়ার কারণে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরাও দেশ ও বিশ্ব-রাজনীতি নিয়ে সচেতন হয়। এবং দর্শন পড়ার কারণে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরাও সামাজিক চিন্তা করতে শিখে। অন্যদিকে, বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদেরকেও দেশের, সমাজের ও মসজিদের নেতৃত্ব দেয়ার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
বাংলাদেশের আলীয়া মাদ্রাসায় কখনোই দর্শন পড়ানো হয় না। বাঙালি মুসলিমরা দর্শনে কাঁচা হবার এটাও একটা কারণ হতে পারে। একইভাবে, আলিয়া মাদ্রাসায় মনোবিজ্ঞানও পড়ানো হয় না, যেটা ব্যক্তি ও সমাজকে বুঝার জন্যে খুবই প্রয়োজন।
যাই হোক, এতগুলো কথা বলার কারণ হলো, ইমাম হাতিপ মাদ্রাসার উদ্দেশ্য হলো সমাজের নেতা তৈরি করা। এজন্যে তাদেরকে কোর’আন, হাদিস, গণিত, পদার্থ, রসায়ন, দর্শন, ভূগোল, ইতিহাস সব পড়তে হয়। কিন্তু আমাদের মাদ্রাসাগুলো আমাদেরকে নেতৃত্ব শেখাতে পারে না। ফলে, আমারা জাতীয় নেতৃত্বে সফলভাবে যেতে পারি না।
25 October 2019 at 8:40pm