|

আধুনিক অর্থনীতির মূলনীতিতে সমস্যা কী?

আধুনিক অর্থনীতির একটি সংজ্ঞা প্রদান করেন লিওনেল চার্লস রবিন্স (১৮৯৮-১৯৮৪)। তিনি বলেন, “অর্থনীতি মানুষের অসীম অভাব ও বিকল্প ব্যবহারযোগ্য সীমিত সম্পদের সম্পর্ক বিষয়ক মানব আচরণ নিয়ে আলোচনা করে।” এল.রবিন্স এর এ সংজ্ঞাটি বেশিরভাগ আধুনিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তার সংজ্ঞাটি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, আধুনিক অর্থনীতি তিনটি মৌলিক বৈশিষ্ট্যের উপর প্রতিষ্ঠিত, যথা ১) অসীম অভাব, ২) সীমিত সম্পদ ও ৩) বিকল্প ব্যবহারযোগ্য সম্পদ।

প্রশ্ন হলো, আসলেই কি মানুষের অভাব অসীম? আসলেই কি মানুষের সম্পদ সীমিত? কোরআন হাদীসে এ বিষয়ে কী বলে?

কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন –

وَآتَاكُم مِّن كُلِّ مَا سَأَلْتُمُوهُ وَإِن تَعُدُّواْ نِعْمَتَ اللّهِ لاَ تُحْصُوهَا إِنَّ الإِنسَانَ لَظَلُومٌ كَفَّارٌ

“যে সকল বস্তু তোমরা চেয়েছ, তার প্রত্যেকটি থেকেই তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন। যদি আল্লাহর নেয়ামত গণনা কর, তবে গুণে শেষ করতে পারবে না। নিশ্চয় মানুষ অত্যন্ত অন্যায়কারী, অকৃতজ্ঞ। “[ সুরা ইবরাহীম ১৪:৩৪ ]

وَمَا مِن دَآبَّةٍ فِي الأَرْضِ إِلاَّ عَلَى اللّهِ رِزْقُهَا وَيَعْلَمُ مُسْتَقَرَّهَا وَمُسْتَوْدَعَهَا كُلٌّ فِي كِتَابٍ مُّبِينٍ

“আর পৃথিবীতে এমন কোনো বিচরণশীল প্রাণী নেই, যার জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহ নেননি। তারা কোথায় থাকে এবং কোথায় সমাপিত হয়। সবকিছুই এক সুবিন্যস্ত কিতাবে রয়েছে। “[ সুরা হুদ ১১:৬ ]

কোরআনের উপরের আয়াত দুটি থেকে স্পষ্ট যে, সকল মানুষের অভাব পূরণের দায়িত্ব আল্লাহর। মানুষ যা-ই চায়, আল্লাহ তায়ালা তাকে তা দেন। এমনকি এত বেশি সম্পদ দেন যে, মানুষ ইচ্ছে করলেও তা হিসাব করে শেষ করতে পারবে না। এর মানে হলো, ইসলামে সম্পদ হলো অসীম।

এবার দেখি, ইসলামের মতে মানুষের অভাব কি অসীম না সীমিত?

এ বিষয়ে রাসূল (স) বলেছেন –

حَدَّثَنَا مَحْمُودُ بْنُ غَيْلاَنَ، حَدَّثَنَا وَهْبُ بْنُ جَرِيرٍ، حَدَّثَنَا شُعْبَةُ، عَنْ قَتَادَةَ، عَنْ مُطَرِّفِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ الشِّخِّيرِ، عَنْ أَبِيهِ، أَنَّهُ انْتَهَى إِلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم وَهُوَ يَقْرَأُ ‏(‏ أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ ‏)‏ قَالَ ‏”‏ يَقُولُ ابْنُ آدَمَ مَالِي مَالِي وَهَلْ لَكَ مِنْ مَالِكَ إِلاَّ مَا تَصَدَّقْتَ فَأَمْضَيْتَ أَوْ أَكَلْتَ فَأَفْنَيْتَ أَوْ لَبِسْتَ فَأَبْلَيْتَ ‏”‏ ‏.‏ قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ ‏.‏

“মুতাররিফ ইবনে ‘আবদুল্লাহ ইবনুশ শিখখীর (র) হতে তার বাবার সূত্রে বর্ণিত আছে, তিনি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট গেলেন। তিনি তখন (সূরা তাকাসুর) “তোমাদেরকে সম্পদের প্রাচুর্যের মোহ আল্লাহ তা’আলা হতে উদাসীন করে ফেলেছে”— (সূরা তাকাসুর ১) পাঠ করছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: আদম সন্তান বলে, আমার মাল; আমার সম্পত্তি। কিন্তু যে জিনিস তুমি দান-খাইরাত করেছ, তা (আল্লাহ তা’আলার খাতায়) জমা রেখেছ, যা খেয়ে শেষ করেছ কিংবা যা পরিধান করে পুরাতন করেছ, এগুলো ব্যতীত তোমার সম্পদ বলতে কিছু নেই।”
(সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), হাদীস নম্বর – ৩৩৫৪)

এ হাদীস থেকে স্পষ্ট যে, মানুষের সম্পদ তা-ই, যা সে খায় এবং পরিধান করে। একজন মানুষ সারা জীবন যতই ভালো খাক এবং যতই ভালো পরিধান করুক, তবু তার একটা সীমা আছে। মানুষ ইচ্ছা করলেই কিন্তু সারাক্ষণ খেতে পারবে না, এবং সারাদিন পোশাক পরিবর্তন করতে পারবে না। যেহেতু মানুষ একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি ইচ্ছা করলেও খেতে পারে না, এবং পরতে পারে না, তাই বুঝা যাচ্ছে মানুষের অভাব আসলে সীমিত।

অর্থাৎ, ইসলামে মানুষের অভাব সীমিত কিন্তু সম্পদ অসীম। কিন্তু আধুনিক অর্থনীতির মৌলিক দর্শনটা ইসলামের ঠিক উলটো। আধুনিক অর্থনীতির মৌলিক সূত্র হলো, মানুষের অভাব অসীম, কিন্তু সম্পদ সীমিত।

এখন প্রশ্ন হলো, “মানুষের অভাব অসীম, কিন্তু সম্পদ সীমিত” – এ কথা বললে ক্ষতিটা কী?

যখন মানুষ মনে করে, “সম্পদ সীমিত, প্রয়োজন অসীম”, তখন মানুষের মাঝে একটা সাইকোলজি কাজ করে, এবং তা হলো, তাড়াতাড়ি নিজের আয়ত্তে সম্পদ কুক্ষিগত করা।

ধরুন, পানির পিপাসী ১০ জন মানুষকে যদি নদীর পাশে এনে ছেড়ে দেয়া হয়, তাহলে প্রত্যেক মানুষ নিজের পানিটা পান করে নিবে, কিন্তু কেউই কারো সাথে ঝগড়া করবে না, এবং কেউ নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি সংগ্রহ করার চেষ্টা করবে না। কারণ, পানি প্রচুর আছে। অন্যদিকে পানির পিপাসী এ ১০ জন মানুষকে যদি ১০ লিটার পানি খেতে দেয়া হয়, তখন তাঁরা পানি নিয়ে মারামারি শুরু করবে। কেউ কেউ চেষ্টা করবে নিজেই ২ বা ৩ লিটার পানি সংগ্রহ করে রাখতে। তখনি শুরু হবে অন্যায় ও জুলুম।

আধুনিক অর্থনীতি মানুষকে বলে, “তোমার প্রয়োজন অনেক, কিন্তু তোমার আশে-পাশে সম্পদ কম। তাই যত পারো তাড়াতাড়ি নিজের জন্য সম্পদ ঘরে তুলে রাখো, নতুবা কিন্তু সম্পদ শেষ হয়ে যাবে।” – এ কথাটা মানুষকে বলা পরে সে নিজের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ জমা করতে শুরু করে। অন্যদিকে কোরআন বলে প্রত্যেক মানুষের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ যাকাত হিসাবে দিয়ে দিতে।

সম্পদ জমা করার সাইকোলজি দূর করার জন্য হাদীসে এসেছে –

حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ الْمُصَفَّى الْحِمْصِيُّ، حَدَّثَنَا الْوَلِيدُ بْنُ مُسْلِمٍ، عَنِ ابْنِ جُرَيْجٍ، عَنْ أَبِي الزُّبَيْرِ، عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ ‏ “‏ أَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا اللَّهَ وَأَجْمِلُوا فِي الطَّلَبِ فَإِنَّ نَفْسًا لَنْ تَمُوتَ حَتَّى تَسْتَوْفِيَ رِزْقَهَا وَإِنْ أَبْطَأَ عَنْهَا فَاتَّقُوا اللَّهَ وَأَجْمِلُوا فِي الطَّلَبِ خُذُوا مَا حَلَّ وَدَعُوا مَا حَرُمَ ‏”‏ ‏.‏

“জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা) বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: হে লোকসকল! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং উত্তম পন্থায় জীবিকা অন্বেষণ করো। কেননা কোন ব্যক্তিই তার জন্য নির্ধারিত রিযিক পূর্ণরূপে না পাওয়া পর্যন্ত মরবে না, যদিও তার রিযিক প্রাপ্তিতে কিছু বিলম্ব হয়। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং উত্তম পন্থায় জীবিকা অন্বেষণ করো, যা হালাল তাই গ্রহণ করো এবং যা হারাম তা বর্জন করো।”
(সুনানে ইবনে মাজাহ – হাদিস নম্বর: ২১৪৪)

ইসলাম বলে তোমার ভাগ্যে যতটুকু সম্পদ আছে, তার জন্য তুমি চেষ্টা করো। তোমার বরাদ্দকৃত সম্পদ অন্য কেউ নিতে পারবে না। তোমার ভাগ্যে যতটুকু সম্পদ আছে, তা না পাওয়া পর্যন্ত তোমার মরণ হবে না। তাই সম্পদের জন্য তাড়াহুড়া করো না। সম্পদ জমা করে রেখো না। অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে নিজে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করো না। ইত্যাদি। অন্যদিকে আধুনিক অর্থনীতি এসব কথার উলটো কথা বলে। তারা বলে “সম্পদ শেষ হয়ে যাবে, তাড়াতাড়ি নিজেরটা নিয়ে নাও।”

আমরা যারা ইসলামী অর্থনীতি চাই, প্রথমেই আমাদেরকে এ চিন্তা পরিহার করতে হবে যে, “আল্লাহ দেয়া সম্পদ সীমিত, এবং মানুষের অভাব অসীম”।

সমাজের অধিকাংশ মানুষ যখন এ চিন্তাটা তার মন থেকে ফেলে দিতে পারবে, তখনি জুলুমহীন অর্থনীতি চালু করা সম্ভব হবে।

আরো পোস্ট

একটি মন্তব্য লিখুন

আপনার ইমেইল অ্যাড্রেস প্রকাশ করা হবে না। তারকা (*) চিহ্নিত ঘরগুলো পূরণ করা আবশ্যক