রাসূলের (সা) যুগে নারীরা কোথায় নামাজ আদায় করতেন?
[ইসলামের সোনালী যুগে মসজিদে নারীদের অবাধ যাতায়াতের সুযোগ ছিল। মহানবীর (সা) ইমামতিত্বে মসজিদে নববীতে নারী-পুরুষ মিলে একই ফ্লোরে নামাজ আদায় করতেন। অথচ, বাংলাদেশের মতো রক্ষণশীল সমাজে হাতেগোনা ব্যতিক্রম বাদে মসজিদগুলোতে নারীদের প্রবেশাধিকারই নেই। যদিও ইসলামের দৃষ্টিতে সামাজিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হলো মসজিদ। মসজিদে নারীদের প্রবেশাধিকার, অবস্থান ও কার্যক্রম ইত্যাদি নিয়ে শায়খ ড. জাসের আওদা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি গবেষণাকর্ম সম্পন্ন করেছেন। আরবীতে লেখা ড. আওদার এই বইটির বাংলা শিরোনাম আমরা দিয়েছি ‘মাকাসিদে শরীয়াহর আলোকে মসজিদ ও নারী প্রসঙ্গ’। অনুবাদ করছেন জোবায়ের আল মাহমুদ। আজ প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় অধ্যায়ের অনুবাদ।] –cscsbd
বর্তমানে মুসলিম দেশগুলোর যেসব মসজিদে নারীদের জন্যে নামাজ আদায় করার ব্যবস্থা রয়েছে, সেসব মসজিদের একই কক্ষে পুরুষদের পেছনে নারীদেরকে কদাচিৎই দাঁড়ানোর অনুমতি দেয়া হয়। অথচ রাসূলের (সা) যুগে মসজিদের একই কক্ষে নারীরা পুরুষদের ঠিক পেছনে নামাজ আদায়ের জন্যে কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতেন।
আরব দেশগুলোতে সাধারণত নারী-পুরুষদের জন্য আলাদা মসজিদ থাকে। বিশেষত ছোট মসজিদগুলোর ক্ষেত্রে এটা সত্য। পুরুষদের মসজিদ থেকে নারীদের মসজিদ কমবেশি দূরেই থাকে। মুসলিম দেশগুলোর বেশিরভাগ মসজিদে নারীদের নামাজ আদায়ের জন্যে মসজিদের নিচ তলা, বেজমেন্ট, আবদ্ধ ব্যালকনি কিংবা মসজিদের সাথে লাগোয়া একটা ছোট্ট বিল্ডিং বরাদ্দ থাকে। এবং নামাজে ইমামের কণ্ঠ শোনার জন্য স্পিকার ব্যবহার করা হয়।
নারীদেরকে পৃথকীকরণের পাঁচটি অসুবিধা
নারীদেরকে এ ধরনের কক্ষে আবদ্ধ করার ফলে বেশ কিছু সমস্যা তৈরি হয়:
প্রথমত, মসজিদের মূল কক্ষের তুলনায় নারীদের কক্ষটি আয়তনে খুবই ছোট থাকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই জুমার নামাজ এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানে নারীদের স্থান সংকুলান হয় না। অথচ একই সময় পুরুষদের নামাজ আদায়ের কক্ষটি এবং মসজিদের আশেপাশের অন্যান্য স্থান ফাঁকাই থেকে যায়। সাধারণ অনুষ্ঠানগুলোতে প্রায়ই নারীদের উপস্থিতি পুরুষদেরকে ছাড়িয়ে যায়। বিশেষত মুসলিম সংখ্যালঘু দেশগুলোতে এমন হয়।
দ্বিতীয়ত, নারীদের নামাজ আদায়ের এই কক্ষে পুরুষদের মতো একই মানের কার্পেট, লাইট, সাউন্ড বক্সসহ অন্যান্য সুবিধাদি দেয়া হয় না। এর ফলে নারীরা মসজিদে পুরুষদের মতো অভ্যর্থনা অনুভব করে না এবং পুরুষদের মতো সুযোগ-সুবিধাও পায় না।
তৃতীয়ত, এ ধরনের মসজিদগুলোতে সাধারণত বাচ্চাদের জায়গা শুধু নারীদের কক্ষেই বরাদ্দ থাকে। এ কারণে সেখানে সবসময় হইচই চলতে থাকে।
চতুর্থত, নারীদেরকে মসজিদের মূল গেইট দিয়ে প্রবেশের অনুমতি দেয়া দেয়া হয় না। বরং তাদের জন্য একটি সংকীর্ণ দরজা কিংবা বিল্ডিংয়ের পেছনদিকের একটি দরজা নির্ধারণ করে দেয়া হয়।
পরিশেষে (যদিও এটা সর্বশেষ নয়), মসজিদের এই প্রচলিত কাঠামোর ফলে অমুসলিম পরিদর্শক এবং নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা মনে করে, ইসলাম বুঝি নারীদেরকে ‘একঘরে’ ও ‘বিচ্ছিন্ন’ করে রাখে। বিশেষ করে নারীদের নামাজের কক্ষটি হইচইপূর্ণ, সংকীর্ণ এবং অপরিচ্ছন্ন দেখে তারা ভাবে, ইবাদাতের স্থানে নারীদের উপস্থিতিকে ইসলাম বোধহয় সমর্থন করে না এবং ইসলাম ধর্মে পুরুষদেরকে বোধহয় শিশু সন্তানের কোনো দায়িত্ব নিতে হয় না। অনেক অমুসলিমের মতো তারাও তখন বলে, ইসলাম কেবল পুরুষদের ধর্ম। মসজিদের এই বৈষম্যমূলক অবস্থা মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবার মনে আসলে এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাবই তৈরি করে।
মসজিদের গঠন বিন্যাসে রাসূলের (সা) সুন্নত
রাসূলের (সা) সময়ে মসজিদের অবকাঠামো ছিল অনেকটা নিম্নরূপ–
পুরুষরা রাসূলের (সা) ঠিক পেছনে কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতে শুরু করতেন এবং প্রথম কাতারটি পূর্ণ হয়ে গেলে তার পেছনের কাতারে দাঁড়াতেন। অন্যদিকে, নারীরা মসজিদের সর্বশেষ কাতার থেকে দাঁড়াতে শুরু করতেন এবং সর্বশেষ কাতারটি পূর্ণ হয়ে গেলে তার সামনের কাতারে দাঁড়াতেন। আর ছোট ছেলেরা পুরুষ ও নারীদের মাঝখানে কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতো। রাসূলের (সা) দীর্ঘ জীবনের সুন্নতী পদ্ধতিটা এমনই ছিল।
প্রথম হিজরীর (৬২২ খ্রি.) রবিউল আউয়াল মাসে রাসূল (সা) একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। আজকের হিসাবে মসজিদটির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ছিল প্রায় ৩৫x৩০ মিটার। খেজুরের ডালে নির্মিত মসজিদটির ছাদের উচ্চতা ছিল প্রায় ২.৫ মিটার। খুঁটিগুলো ছিল খেজুর গাছের কাঁদি দিয়ে তৈরি। আর দেয়াল ছিল রোদে পোড়ানো ইটের তৈরি। রাসূল (সা) মসজিদের ভিতরটা প্রশস্ত রেখেছিলেন এবং মসজিদের তিনদিকে তিনটি দরজা তৈরি করেছিলেন। এ দরজাগুলো দিয়ে নারী-পুরুষ উভয়ে সমানভাবে প্রবেশ করত।
মসজিদের পশ্চিমের দরজাটির নাম হলো ‘রহমতের দরজা’। এটিকে ‘বাব আল-আতিকাহ’-ও বলা হয়। পূর্ব পাশের দরজাটি হলো ‘উসমানের দরজা’। এটাকে এখন ‘জিবরাঈলের দরজা’ বলা হয়। এই দরজাটি দিয়ে রাসূল (সা) প্রবেশ করতেন। আর দক্ষিণ পাশে আরেকটি দরজা ছিল। তখন কিবলা ছিল বায়তুল মুকাদ্দাসের দিকে। তৃতীয় হিজরিতে মক্কার দিকে কিবলা পরিবর্তন করা হলে দক্ষিণ দিকের দরজাটি বন্ধ করে দিয়ে উত্তর দিকে একটি দরজা খোলা হয়।[1]
নারী-পুরুষের কাতারের মাঝখানে কোনো বিল্ডিং, দেয়াল বা পর্দা ছিল না। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তাঁরা এমন কিছু করেননি। বরং পুরুষদের শেষ কাতারের পরেই সরাসরি নারীদের প্রথম কাতার ছিল। অনেকগুলো হাদীসে এই বিষয়টি বর্ণিত হয়েছে।
যেমন, উরওয়া বিন জোবায়ের বর্ণিত হাদীসটি, যা আসমা বিনতে আবু বকর (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন–
আমাদের মধ্য থেকে রাসূল (সা) উঠে দাঁড়ালেন এবং আমাদের উদ্দেশ্য বক্তব্য প্রদান করলেন। তিনি বললেন, আসল ফিতনা হলো যা কোনো মানুষের কবরে ঘটে থাকে।
কথাটি বলার পরেই লোকজন আওয়াজ করতে লাগলো। ফলে রাসূলের (সা) শেষ কথাটি বুঝতে আমার সমস্যা হয়েছিল।[2] তারপর লোকেরা নীরব হলে আমি আমার কাছের পুরুষটিকে বললাম, আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন! রাসূল (সা) তাঁর বক্তব্যের শেষে কী বলছিলেন?
পুরুষটি জবাব দিলেন, ‘আমার উপর এই মর্মে ওহী অবতীর্ণ হয়েছে– তোমরা কবরে যে ধরনের ফিতনার সম্মুখীন হবে, সেটা দাজ্জালের ফিতনার মতোই।’[3]
এরপর ফাতিমা বিনতে কায়েস (রা) কর্তৃক বর্ণিত আরেকটি হাদীসের কথা বলা যায়। তিনি বলেন–
জামায়াতে নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্যে মানুষদেরকে আহবান করা হলো। তাদের সাথে আমিও নামাজ আদায় করতে গেলাম। আমি ছিলাম নারীদের প্রথম কাতারে এবং আমার কাতারটি ছিল পুরুষদের কাতারের ঠিক পেছনে। আমি নবীর (সা) কথা শুনছিলাম। তিনি মসজিদের মিম্বরে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন, তামীম আদ-দারীর চাচার বংশ সাগরে যাত্রা করেছে….।[4]
সরাসরি ইমামের নিকট থেকে নারীদের শিক্ষাগ্রহণ
রাসূলুল্লাহ (সা) খুতবা দেয়ার সময় নারীরা তাঁকে দেখতে পেতেন। কারণ, নারীরা একই ফ্লোরেই অবস্থান করতো। সরাসরি কারো কাছ থেকে কিছু শুনলে তাতে ভালোভাবে মনোযোগ প্রদান ও তা থেকে যথাযথভাবে শিক্ষাগ্রহণ করা সম্ভব হয়। এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। এমনও হয়েছে, কোনো কোনো নারী রাসূলের (সা) কাছ থেকে সরাসরি তেলাওয়াত শুনে কোরআন মুখস্ত করে ফেলেছেন। উম্মে হিশাম বিনতে হারেসা বিন নোমান (রা) বলেন–
রাসূল (সা) প্রত্যেক জুমায় তাঁর বক্তব্যে সূরা কাফ তেলাওয়াত করতেন। আমি কেবল তাঁর নিকট থেকে শুনেই সূরাটি মুখস্থ করে ফেলেছি।[5]
ইবনে আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত আরেকটি হাদীস রয়েছে। তিনি বলেন–
উম্মুল ফজল বিনতে হারেস (রা) আমার কাছ থেকে ‘ওয়াল মুরসালাতি উরফা’ (সূরা মুরসালাত) পাঠ করতে শুনেছিলেন। উম্মুল ফজল মন্তব্য করলেন, হে বৎস আমার! তোমার তেলাওয়াত আমাকে মনে করিয়ে দিলো, আল্লাহর রাসূলের (সা) নিকট থেকে আমার শোনা এটাই হচ্ছে সর্বশেষ সূরা। মাগরিবের নামাজে তিনি এটি তেলাওয়াত করেছিলেন।[6]
রাসুলুল্লাহর (সা) স্ত্রী উম্মে সালমার (রা) দাস আবদুল্লাহ বিন রাফি হতে বর্ণিত। উম্মে সালমা (রা) বলেন–
আমি হাওজ (হাওজে কাউসার) সম্পর্কে লোকদেরকে আলোচনা করতে শুনতাম। কিন্তু আমি নিজে রাসুলুল্লাহর (সা) নিকট থেকে এ সম্পর্কে কিছু শুনিনি। একদিন একটি মেয়ে আমার চুল আঁচড়িয়ে দিচ্ছিল, এমন সময় রাসুলুল্লাহর (সা) আহবান শুনলাম – ‘হে মানুষ সকল!’
তখন আমি মেয়েটিকে বললাম, তুমি এখন চলে যাও।
সে আমাকে বলল, রাসূলুল্লাহ (সা) তো পুরুষদের ডেকেছেন, নারীদের ডাকেননি।
আমি বললাম, আমিও তো মানুষদের একজন।
তারপর, রাসুলুল্লাহ (সা) বললেন, হাওজের ব্যাপারে আমিই হবো তোমাদের অগ্রদূত। তাই সাবধান! আমার কাছে তোমাদের এমন কেউ যেন না আসে, যাকে হারানো উটের মতো আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়া হবে। আর আমি বলবো, কেন তাদের তাড়ানো হচ্ছে? তখন আমাকে বলা হবে, আপনি তো জানেন না, তারা আপনার পরে কী কী নতুন বিষয়ের (বিদআত) উদ্ভাবন করেছে। তখন আমিও বলবো – দূর হও![7]
আবু উসমান (রা) থেকে বর্ণিত–
আমি জানতে পেরেছি, নবীজীর (সা) কাছে জিবরীল (আ) এসেছেন। তখন উম্মে সালমা (রা) তাঁর পাশে ছিলেন। জিবরীল রাসূলের (সা) সাথে কথা বললেন। তখন নবী (সা) উম্মে সালমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এ লোকটি কে? উম্মে সালমা (রা) বললেন, ইনি দাহইয়া (রা)।
জিবরীল চলে যাওয়ার পর উম্মে সালমা (রা) বললেন, আল্লাহ্র কসম! নবীজী (সা) খুতবায় জিবরীলের খবরটা আমাদেরকে জানানোর আগ পর্যন্ত আমি তাঁকে দাহইয়া বলেই মনে করেছিলাম।[8]
আসমা বিনতে আবু বকর (রা) থেকে আরেকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন–
রাসুলুল্লাহর (সা) জীবদ্দশায় একবার সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। … তারপর আমি এসে মসজিদে প্রবেশ করে দেখতে পেলাম, রাসুলুল্লাহ (সা) নামাজে দাঁড়িয়ে আছেন। আমিও তাঁর সাথে দাঁড়িয়ে নামাজে শামিল হলাম। তিনি এতো দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকলেন যে আমার বসে যেতে ইচ্ছা করছিল। এমন সময় আমি খেয়াল করলাম, একজন দুর্বল মহিলাও আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তখন আমি বললাম, এই মহিলা তো আমার চেয়েও দুর্বল। কাজেই আমিও দাঁড়িয়ে থাকলাম। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) রুকু করলেন। রুকুতে তিনি দীর্ঘ সময় থাকলেন। তারপর মাথা উঠিয়ে এমনভাবে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন যে, বাহির থেকে তখন কেউ আসলে তার কাছে মনে হবে, তিনি বুঝি রুকুই করেননি।[9]
উপরোক্ত হাদীসগুলো থেকে প্রমাণ হয়, নারীরা মসজিদে রাসূলুল্লাহকে (সা) দেখতে পেতেন। নারীদের শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রে এবং মসজিদে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে উপকৃত হবার ক্ষেত্রে এটি ইতিবাচক প্রভাব রেখেছে। সুতরাং, নারীদেরকে কোনো দেয়াল বা পর্দার মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন করে রাখার কোনো কারণ নেই। ইমামকে দেখার ব্যাপারেও নারীদের কোনো নিষেধ নেই। তবে নারী-পুরুষের মধ্যে অবাঞ্চিত ভীড়ভাট্টা বা গাদাগাদি পরিবেশ এড়ানোর জন্য নামাজের স্থানকে নির্দিষ্ট করে দেয়া প্রয়োজন। এ জন্য ফ্লোরের মাঝখানে একটা দাগ টেনে দেয়া বা নিচু বেড়া দিয়ে দেয়াই যথেষ্ট।
মন্দ কাতার সংক্রান্ত হাদীসের অর্থ
নামাজের কাতার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহর (সা) একটি হাদীস আবু হোরায়রা (রা) বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন–
রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘পুরুষদের প্রথম কাতারটি উত্তম এবং শেষ কাতারটি মন্দ। আর নারীদের শেষ কাতারটি উত্তম এবং প্রথম কাতারটি মন্দ।’[10]
নারীদেরকে মসজিদে আসতে নিষেধ করতে কিংবা মসজিদে নারীদেরকে আলাদা কক্ষে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে কেউ কেউ এই হাদীসটিকে প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করেন। এটি খুবই অদ্ভূত ব্যাপার! কারণ, রাসূলুল্লাহ (সা) চাইলে নারীদের জন্যে পৃথক কক্ষ তৈরি, কিংবা নারীদেরকে মসজিদে আসতে নিষেধ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি এর কোনোটিই করেননি।
পুরুষরা যেন প্রথম কাতার এবং নারীরা যেন শেষ কাতারে দাঁড়ানোকে অগ্রাধিকার দেয় – এর উপর জোর দেয়াই কেবল হাদীসটির উদ্দেশ্য। এর অন্য আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। ব্যাপারটা সহজেই বোধগম্য ও যৌক্তিক।
প্রথমত, মসজিদে যিনি আগে আসবেন, তিনি পুরুষ হলে পুরুষদের সামনের কাতারে দাঁড়াবেন আর নারী হলে নারীদের পেছনের কাতারে দাঁড়াবেন। এভাবে একে একে আসা মুসল্লীদের দ্বারা মসজিদ পূর্ণ হবে। এটি খুবই প্রচলিত ঐতিহ্য।
দ্বিতীয়ত, নামাজে অমনোযোগিতা এড়ানোর জন্য মসজিদের মধ্যে এই দুই কাতারই সবচেয়ে উত্তম। এই দুই কাতারের কোনো একটিতে দাঁড়ালে নামাজে নিরবচ্ছিন্ন একাগ্রতা তৈরি হয় এবং পরিপূর্ণ ভক্তি সহকারে নামাজ আদায় করা যায়।
তৃতীয়ত, এই নির্দেশনাটি অন্য আরেকটি হাদীসের সাথেও মিলে। সেই হাদীসে রাসূল (সা) নারীদেরকে পুরুষদের আগে সেজদা থেকে মাথা তুলতে নিষেধ করেছিলেন। কারণ, প্রাথমিক যুগে মুসলমানদের আর্থিক দৈন্যতা এতোটাই করুণ ছিল যে, অনেক সাহাবীর একটিমাত্র লম্বা কাপড়ও ছিল না, যা দিয়ে তিনি সেজদা অবস্থায় নিজের সতর ঢাকতে পারতেন।
আসমা বিনতে আবু বকর (রা) থেকে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন–
আমি রাসূলুল্লাহকে (সা) বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে যে নারী আল্লাহ তায়ালা ও শেষ দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন আমাদের মাথা তোলার আগে তার মাথা না তোলে।” তখন পুরুষেরা যে পোশাক পরিধান করতো তা ছোট হওয়ায় নারীরা তাদের সতর দেখে ফেলার আশংকা ছিল।[11]
সাহল বিন সাইদ (রা) থেকে বর্ণিত এ রকম আরেকটি হাদীস রয়েছে। তিনি বলেন–
রাসূলের (সা) যুগে পুরুষেরা সেজদা থেকে উঠে অসঙ্গত কাপড় ঠিক করে উঠে না বসা পর্যন্ত নারীদেরকে মাথা তুলতে নিষেধ করা হয়েছিলো (অন্য একটি বর্ণনায় ‘অসঙ্গত’ শব্দটির পরিবর্তে ‘সংক্ষিপ্ত’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে )।
এছাড়া, আরেকটি বর্ণনায় নারীদের উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, পুরুষদের সতর দেখা থেকে তোমরা নিজেদের চোখকে হেফাজত করো।[12]
আমর বিন সালামাহ (রা) থেকেও এ রকম একটি হাদীস বর্ণিত আছে। তিনি বলেন–
…(নামাজে ইমামতি করার জন্যে) তারা সবাই কাউকে খুঁজছিল। কিন্তু আমার চেয়ে কোরআন বেশি জানা কাউকে পাওয়া গেল না। এর কারণ হলো, আমি কাফেলার পথিকদের নিকট থেকে কোরআন শিখতাম। তারা আমাকে ইমামতি করার জন্য সামনে ঠেলে দিলো। অথচ তখন আমি ছিলাম মাত্র ছয় বা সাত বছরের বালক। আমার গায়ে ছিল ছোট্ট একখণ্ড কাপড়। ফলে সিজদা করতে গেলে আমার গা অনাবৃত হয়ে পড়তো। তখন গোত্রের একজন নারী পুরুষদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘তোমাদের ক্বারী সাহেবের সতর ঢাকার জন্যে আমাদের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা করবো নাকি?’ তারপর তারা একটি কাপড় কিনল এবং সেটা কেটে আমাকে একটা জামা বানিয়ে দিলো। এই জামাটি পেয়ে আমি এত খুশি হয়েছিলাম যে, অন্য আর কিছু পেয়ে কখনো এত খুশি হইনি।[13]
অতএব, নারী ও পুরুষের কাতারের মাঝে দূরত্ব থাকা এবং নারীদেরকে পেছনের কাতারে দাঁড়াতে উৎসাহিত করার পেছনে এটাও একটা যৌক্তিক কারণ।
তাই সাধারণ নিয়ম হলো, প্রথম কাতারকে অগ্রাধিকার দেয়া। তারপর দ্বিতীয় কাতার, তারপর তৃতীয় কাতার, এভাবে শেষ পর্যন্ত। পুরুষদের জন্যে এই নিয়মটা সবসময় বহাল থাকবে। পুরুষদের জামায়াতে না গিয়ে নারীরা এককভাবে নিজেদের জামায়াত আয়োজন করলে নারীদের ক্ষেত্রেও উপরের এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে। কিন্তু তারা পুরুষদের সাথে একই ফ্লোরে নামাজ আদায় করলে উপরে উল্লেখিত হাদীস অনুসারে নারীদের জন্যে শেষ কাতারটি হবে উত্তম কাতার।[14]
সামনে দিয়ে কোনো নারী হেঁটে গেলে পুরুষের নামাজ নষ্ট হওয়ার আশংকা
মসজিদে খোলামেলা পরিবেশের বিরোধিতা করে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেন– কোনো নারী নামাজ আদায়রত পুরুষের সামনে দিয়ে হেঁটে গেলে পুরুষের নামাজ নষ্ট হয়ে যায়। এমনকি কেউ কেউ মনে করে, এই নামাজ পুনরায় আদায় করতে হবে। অথচ মসজিদ সম্পর্কে রাসূলের (সা) যে মুতাওয়াতির বা সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে, সেটি এই ধারণার বিপরীত। তারা নিজেদের মতের সমর্থনে একটি সহীহ হাদীস উল্লেখ করেন, যা আবু হোরায়রা ও আবু জর (রা) থেকে বর্ণিত। নবী (সা) বলেন, ‘নারী, কুকুর ও গাধা নামাজ নষ্ট করে’।[15]
কিন্তু আসলে এই বর্ণনাগুলো স্বয়ং আবু হোরায়রারই (রা) অন্য একটি বর্ণনার সাথে সাংঘর্ষিক। আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেন, ‘নারী, কুকুর বা গাধার কারণে কারো নামাজ নষ্ট হয় না। এসব ক্ষেত্রে সতর্ক থাকবে এবং সম্ভব হলে হাত দিয়ে দূরে সরিয়ে দেবে।[16] অবশ্য এই হাদীসটি সহীহ হিসাবে প্রমাণিত হয়নি।
যদিও ‘নামাজ নষ্ট হয় না’ জাতীয় হাদীসগুলোর তুলনায় ‘নামাজ নষ্ট হয়ে যাবে’ জাতীয় হাদীসগুলো সনদগতভাবে অধিক সহীহ। কিন্তু এই ইস্যুতে উম্মুল মুমিনীন আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত সহীহ হাদীস রয়েছে, যা মুসলিম শরীফ ও অন্যান্য গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘নারীদের কারণে পুরুষদের নামাজ নষ্ট হয়ে যাবে’ জাতীয় হাদীসগুলোকে আয়েশা (রা) অপ্রাসঙ্গিক মনে করতেন।
আবদুল্লাহ ইবনে উবাইদ বিন উমাইর (রা) আয়েশা (রা) থেকে বর্ণনা করে বলেন, কুকুর, নারী ও গাধার কারণে নামাজ নষ্ট হয় কিনা, আয়েশাকে (রা) তা জিজ্ঞাসা করা হলো। তিনি বললেন, ‘তোমরা কি এই প্রাণীগুলোর সাথে মুসলিম নারীদের তুলনা করো? অথচ আমি ঘুম থেকে জেগে উঠে রাসূলুল্লাহকে (সা) দেখেছি, তিনি নামাজ আদায় করছিলেন, আর আমি তখন রাসূলুল্লাহ (সা) ও কাবা শরীফের মাঝখানে শোয়া অবস্থায় ছিলাম।’[17]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, আয়েশা (রা) বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সা) ও কাবার মাঝখানে আমি এমনভাবে শোয়া ছিলাম, যেভাবে মৃত মানুষকে জানাজার নামাজে শোয়ানো হয়।’[18]
অন্য একটি বর্ণনা মতে আয়েশা (রা) বলেছেন, ‘কতই না খারাপ! তোমরা আমাদেরকে কুকুর ও গাধার সাথে তুলনা করো!’ অন্য আরেকটি বর্ণনা অনুযায়ী তিনি বলেছেন, ‘তাহলে নারীরা কি বিশ্রী প্রাণীদের মতো?’
এই ইস্যুতে ইমাম শাফেয়ীর মতামত হলো, নারীরা মুসল্লিদের সামনে থাকলে নামাজ নষ্ট হবে না। তারা মুসল্লিদের ডানে বা বামে থাকলেও নামাজ নষ্ট হবে না।[19]
মোহাম্মদ বিন হাসান বলেছেন– পুরুষদের সামনে নারীরা ঘুমিয়ে থাকুক, দাঁড়ানো বা বসা অবস্থায় থাকুক, অথবা নারীরা পুরুষদের পাশে থাকুক কিংবা পুরুষদের সামনে ভিন্ন নামাজ আদায় করুক, এতে পুরুষদের নামাজের কোনো ক্ষতি হবে না। তবে নারী-পুরুষ একই নামাজ আদায় করার সময় অথবা একই ইমামের পিছনে দাঁড়ানো অবস্থায় নারীরা পুরুষদের সামনে বা পাশে দাঁড়ালে নামাজ মাকরুহ হবে।[20]
হাম্বলী মাজহাবের মতে, পুরুষদের নামাজের সামনে নারীরা নামাজ আদায় করলে পুরুষদের নামাজ মাকরুহ হবে। কিন্তু নারীরা নামাজ আদায়রত না থাকলে পুরুষদের নামাজ মাকরুহ হবে না। এখানে আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত হাদীসটি উল্লেখ করা হয়।[21]
আবু দাউদ উল্লেখ করেছেন, এই ইস্যুতে সাহাবীদের প্রতিক্রিয়া থাকা সত্ত্বেও নামাজ নষ্ট হবে না। কেননা, হাদীস দুটি পরস্পরবিরোধী। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহর (সা) দুটি হাদীস পরস্পররবিরোধী হলে তাঁর পরবর্তীতে সাহাবীদের আমলের প্রতি লক্ষ্য করতে হবে।[22]
মসজিদে শিশুদের জায়গা ও অবস্থান
শিশুদের মাঝে যারা একটু বড় ছিল, রাসূলের (সা) যুগে তারা আলাদাভাবে অন্য একটি কাতারে দাঁড়াতো। এমনকি তাদের কেউ কেউ নামাজের ইমামতিও করতো। ইতোপূর্বে শিশু সাহাবী আমর বিন সালামাহ (রা) কর্তৃক ইমামতি করার একটি উদাহরণ উল্লেখ করেছি। অথচ বর্তমান সময়ে শিশুদের ইমামতি ও নামাজে কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানোর এই ধারণাটা খুবই বিরল। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের ইসলামী শিক্ষা কার্যক্রম সম্পর্কে অভিজ্ঞ ব্যক্তি মাত্রই এ ব্যাপারে অবগত আছেন। বর্তমান যুগে এমন বুদ্ধিমান শিশুর সংখ্যা খুব কম, যারা নিজের নামাজের ব্যাপারে সচেতন এবং যাদেরকে মসজিদে যেতে তাগিদ দিতে হয় না। এ কারণে শিশুরা মসজিদে তাদের পিতামাতার সঙ্গে থাকাটাই যথোপযুক্ত। আর নয়তো শিশুদেরকে এমন একটি কামরায় রাখা উচিত, যেখানে শিশুদের পরিচর্যা ও প্রশিক্ষণের জন্যে বিজ্ঞ কিছু স্বেচ্ছাসেবক ও স্বেচ্ছাসেবিকা থাকবে। বিশেষত যেসব অনুষ্ঠানে শিশুদের সমাগম বেশি হয়, সেখানে এমন ব্যবস্থা থাকা উচিত।
নামাজের সময় প্রাপ্তবয়স্কদের মাধ্যমে শিশুদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া প্রিয় নবীর (সা) একটি সুন্নতও বটে। ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন –
এক রাতে আমি নবীজীর (সা) বাম পাশে নামাজে দাঁড়ালাম। এরপর তিনি আমার হাত বা বাহু ধরে টেনে নিয়ে তাঁর ডান পাশে দাঁড় করিয়ে দিলেন। অথবা, হাত দিয়ে তাঁর পিছনে সরিয়ে দিলেন।[23]
অন্য একটি বর্ণনায় ইবনে আব্বাস (রা) বলেন–
একদিন ফজরের নামাজের ইকামাত হয়ে যাবার পর আমি দুই রাকাত (সুন্নত) নামাজ আদায়ের জন্যে দাঁড়ালাম। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) আমার হাত ধরে ফেললেন এবং বললেন, “তুমি কি ফজরের নামাজ চার রাকাত আদায় করবে নাকি?”[24]
আমাদের সমাজে সাধারণত শিশুদেরকে – বিশেষত মেয়ে শিশুদেরকে – মসজিদে যেতে নিষেধ করা হয়। অথচ এটি রাসূলের (সা) সুস্পষ্ট সুন্নতের বিপরীত একটি একটি কাজ। ‘নামাজরত অবস্থায় বাচ্চা মেয়েকে কাঁধে রাখা সংক্রান্ত অধ্যায়’ শিরোনামে সহীহ বুখারীতে একটি অধ্যায়ই রয়েছে। এই অধ্যায়ে আবু কাতাদা আল আনসারী (রা) বর্ণনা করেন –
রাসূলুল্লাহ (সা) শিশু উমামাহকে কাঁধে নিয়ে নামাজ আদায় করছিলেন। উমামাহ হলো রাসূলুল্লাহর (সা) কন্যা জয়নাবের (রা) মেয়ে। উমামাহর পিতা হলেন আবুল আস বিন রাবিয়া বিন আবদে শামস। রাসূল (সা) সেজদায় গেলে উমামাহকে নামিয়ে রাখতেন এবং উঠে দাঁড়ানোর সময় আবার তাকে কাঁধে উঠিয়ে নিতেন।[25]
রাসূল (সা) বলেন, আমি নামাজে দাঁড়ানোর পর তা দীর্ঘায়িত করার ইচ্ছা করি। কিন্তু যখন শিশুর কান্না শুনি, তখন নামাজ সংক্ষিপ্ত করে ফেলি। তা না করলে শিশুর মা হয়তো কষ্ট পাবে।[26]
একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) সেজদায় থাকা অবস্থায় হাসান বা হোসাইন এসে তাঁর পিঠে চড়ে বসলেন। ফলে তিনি দীর্ঘক্ষণ সেজদায় থাকলেন। পরে রাসূলকে (সা) জিজ্ঞেস করা হলো – হে আল্লাহ্র নবী, আপনি সেজদা দীর্ঘ করলেন কেন? তিনি বললেন, আমার সন্তানেরা আমার পিঠে চড়েছে। তারা যতক্ষণ সেখানে থাকতে চেয়েছে, ততক্ষণ আমি তাদেরকে বিরক্ত করতে চাইনি।
অন্য একদিন রাসূল (সা) নামাজ আদায় করছিলেন। তিনি যখন সেজদায় গেলেন, তখন হাসান এবং হোসাইন লাফ দিয়ে তাঁর পিঠে চড়ে বসলেন। সাহাবীগণ তাদেরকে বাধা দিতে চাইলে রাসূল (সা) ইশারা করলেন যাতে তাদেরকে বাধা না দেয়া হয়। পরে নামাজ শেষ করে তিনি তাদেরকে কোলে তুলে নেন।[27]
মসজিদে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যে একই দরজা থাকা সুন্নত
রাসূল (সা) এবং তাঁর পরবর্তীতে আবু বকরের (রা) সময় নারী-পুরুষ উভয়ই মসজিদের দরজাগুলো যৌথভাবে ব্যবহার করতেন। তারপর উমর (রা) নারীদের জন্যে একটি দরজা নির্দিষ্ট করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং পুরুষদেরকে সেই দরজা দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করতে নিষেধ করেন। কিন্তু তিনি কখনোই নারীদেরকে পুরুষদের দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে নিষেধ করেননি। সুনানে আবু দাউদে ইবনে উমর (রা) থেকে নাফির বর্ণনা মতে, উমর (রা) বলেন, আমরা যদি এই দরজাটি নারীদের জন্যে ছেড়ে দিতাম! নাফি থেকে অন্য একটি বর্ণনায় রয়েছে, উমর (রা) নারীদের দরজা দিয়ে পুরুষদের প্রবেশ করাকে বারণ করতেন।[28]
নারীদের জন্যে মসজিদের দরজা নির্দিষ্ট করে দেয়ার ব্যাপারটা ছিল উমরের (রা) প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। এটি রাসূলুল্লাহর (সা) সময় থেকে চলে আসা কোনো প্রথা নয়। উমর (রা) নারীদের দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে যে নিষেধ করেছেন, এর উদ্দেশ্য ছিল জনস্বার্থ। এটি এমন কোনো নিষেধাজ্ঞা নয়, যা সব যুগে এবং সকল স্থানে অবশ্যই বর্জনীয়। এছাড়া নারী-পুরুষের যৌথ দরজার বিধানও এর দ্বারা নাকচ হয়ে যায় না।
বর্তমানে, বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যালঘু দেশগুলোতে, নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যে মসজিদের প্রধান দরজা উন্মুক্ত রাখা হয়। এমনকি অবস্থার প্রয়োজনে নারীদের জন্যে অতিরিক্ত একটি বিশেষ দরজার ব্যবস্থাও করা হয়। কিন্তু তারপরও নারীরা তথাকথিত ‘পুরুষদের দরজা’ দিয়ে প্রবেশ করলে তাদেরকে খারাপ কিছু বলা, কিংবা তাদের সাথে ভালো ব্যবহার না করাটা একদম অনুচিত। যদিও দুঃখজনকভাবে আজকাল এমনটি ঘটছে।
আসলে, মসজিদে নারীদের সাথে খারাপ ব্যবহার করা খুবই বড় ধরনের একটি সমস্যা। মুসলিম তরুণ প্রজন্মকে এই সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এমন ব্যবহারের ফলে তরুণ প্রজন্ম ইসলাম ও ইসলামের ধারক-বাহকদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অমুসলিমরাও ইসলামের দাওয়াত থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অমুসলিমদের সাথে বসবাসকারী মুসলিমরা বিষয়টা ভালোভাবেই জানেন।
সারসংক্ষেপ
নারীদেরকে একটি কক্ষে পৃথক করে রাখা, কিংবা নারী-পুরুষের মাঝে দেয়াল বা পর্দা টানিয়ে দেয়াটা কোনো ধরনের সুন্নত নয়। বরং মসজিদের একই কক্ষে পুরুষদের পেছনে নারীদের নামাজ আদায়ের স্থান নির্ধারণ করাই হলো সুন্নত। পুরুষেরা প্রথম কাতার থেকে কাতার শুরু করবে, আর নারীরা শুরু করবে শেষ কাতার থেকে।
নামাজের জামায়াত ব্যতীত অন্য সময়, এমনকি কোনো পুরুষ একা নামাজ আদায় করার সময়ও মসজিদের ভেতর নারীদের হাঁটাহাঁটি করায় কোনো বাধা বা ক্ষতি নেই। ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে শিশুদেরকে মসজিদে যেতে বাধা দেওয়া এবং শুধু নারীদের উপর শিশুদের দেখাশোনার ভার চাপিয়ে দেয়া সুন্নতসম্মত নয়। অবশ্য কোনো জনাকীর্ণ স্থানে নারীদের জন্যে মসজিদের দুই পাশের দুটি দরজা খাস করে দেয়া যায়। নারী-পুরুষের নামাজের জায়গা পৃথক করার জন্যে মসজিদের ফ্লোরে একটা দাগ টেনে দেয়া যায়, কিংবা কোনো নির্দেশনা ব্যবহার করা যায়। এসব কাজ বৈধ। কিন্তু নারীদেরকে মসজিদে প্রবেশে বাধা দেয়া যাবে না। ইসলামের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরা, ইসলামের দিকে মানুষকে দাওয়াত দেয়া এবং নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের মনস্তত্ত্ব গঠনের জন্যে মসজিদে নারীদের অবস্থানের বিষয়টি মুসলমানদেরকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত।
[লেখাটি সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়েছে সমাজ ও সংস্কৃতি অধ্যয়ন কেন্দ্রে। এরপর, উস্তাদ জাসের আওদার ওয়েবসাইটে এবং বাংলাদেশের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাকে ১ম পর্ব, ২য় পর্ব, ও ৩য় পর্ব আকারে প্রকাশিত হয়]
রেফারেন্স ও নোট:
[1] দেখুন, ইবনে সাদ, আত-তাবকাতুল কুবরা, ৩/৬০৯ এবং ওফা আল-ওফা বি-আখবার দার আল-মুসতাফা, ১/২৪৯-২৭৫।
[2] সহীহ বুখারী, জানাজা অধ্যায়, ৩/৪৭৯।
[3] হাদীসটির প্রথম অংশটি বুখারী থেকে বর্ণিত হয়েছে এবং বাকি অংশ নাসায়ী থেকে বর্ণিত হয়েছে। নাসায়ী – ৭/২০০। তিনি বুখারীর সনদ অনুযায়ী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।
[4] সহীহ মুসলিম, ফিতনা অধ্যায়, ৮/২০৫।
[5] সহীহ মুসলিম, জুম’আ অধ্যায়, ৩/১৩
[6] সহীহ বুখারী, আজান অধ্যায়, ২/৩৮৮। সহীহ মুসলিম, নামাজ অধ্যায়, ২/৪০।
[7] সহীহ মুসলিম, ফজিলত অধ্যায়, ৪/১৭৯৫।
[8] সহীহ বুখারী, গুণাবলী অধ্যায়, ৭/৪৪২। সহীহ মুসলিম, সাহাবীদের ফজিলত অধ্যায়, ৭/১৪৪।
[9] সহীহ মুসলিম, সূর্য গ্রহণ অধ্যায়, ৩/৩২।
[10] সহীহ মুসলিম, নামাজ অধ্যায়, ২/৩২; এবং অন্যান্য হাদীস গ্রন্থ।
[11] মুসনাদে আহমদ, ৪৪/৫১১। আরনাবুত বলেন, এই হাদীসটি অন্য একটি হাদীসের কারণে সহীহ। মূলত আসমার (রা) দাসকে নিয়ে সন্দেহ থাকায় এই সনদটি দুর্বল হয়েছে। অনেক বর্ণনাকারী কেবল ‘আসমার দাস’ বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু হাফিজ আল মাযয়ী তাঁর ‘তাহজীব আল কামাল’ গ্রন্থে ‘অজ্ঞাতনামা পুরুষ’ অধ্যায়ে ব্যাখ্যা করেন, ‘ঐ লোকটা যদি আবদুল্লাহ বিন কায়সান না হয়ে থাকে, তাহলে তিনি কে, আমি জানি না।’ ঐ বর্ণনাকারী ব্যতীত অন্যান্য বর্ণনাকারীরা ইমাম বুখারী ও মুসলিম উভয়ের কাছেই বিশ্বস্ত।
[12] সহীহ ইবনে খুজাইমাহ – ২/৮১৭। মাওয়ারিদুজ্জামান – ১/১৩৬
[13] সহীহ বুখারী – ৫/১৫০
[14] আল মাজমু’ শরহে আল মাজহাব – ৪/৩০১। বাদায়ী আস-সানায়ী ফি তারতীব আশ-শারায়ী – ১/১৯৫। এবং একই ইস্যুতে বর্ণিত অন্যান্য হুকুমগুলো।
[15] সহীহ মুসলিম – ১/৩৬৫। মুসনাদে আহমদ – ২/২৯৯। সহীহ ইবনে হিব্বান – ৬/১৫১। সুনানে ইবনে মাজাহ – ১/৩০৫। শুয়াইব আল আরনাভুত বলেন, এই হাদীসের রাবীগণ ইমাম বুখারী ও মুসলিমের কাছে বিশ্বস্ত। তবে কাতাদাহকে নিয়ে বেশ মতপার্থক্য রয়েছে।
[16] সুনানে দারাকুতনি – ২/১৯৬। সুনানে আবু দাউদ, মুয়াত্তা ও মুসনাদে আহমদেও একই ধরণের বর্ণনা রয়েছে।
[17] মুসনাদে ইসহাক বিন রাহাবিয়াহ – ৩/৬১৩। সহীহ ইবনে হিব্বান – ৬/১১১। সুনানে আবু দাউদ – ১/১৮৯। আলবানী বলেছেন, সুনানে আবু দাউদের এই বর্ণনাটি সহীহ।
[18] সহীহ মুসলিম – ১/৩৬৬।
[19] আল-উম্ম – ১/১৯৮।
[20] মুহাম্মদ বিন হাসানের বর্ণিত মুয়াত্তা – ২/৫৮।
[21] কাশশাফ আল-কিনা, মতন আল-ইকনা – ১/৩৩০।
[22] সুনানে আবু দাউদ – ২/৪৪।
[23] সহীহ বুখারী, নামাজ অধ্যায়, ১/২৫৫
[24] ইবনে হিব্বান, ৬/২২১
[25] সহীহ বুখারী, ১/১০৯
[26] সহীহ বুখারী, ১/১৪৩
[27] আনাস (রা) থেকে যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, তা আবু ইয়ালি আল মাওসালী রচিত গ্রন্থ ‘জাওয়ায়িদে’ রয়েছে। তবে একই ধরনের বর্ণনা সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমেও রয়েছে।
[28] সুনানে আবু দাউদ, ১/৩৪৮। মসজিদে নারীদেরকে পুরুষদের থেকে পৃথকীকরণ অধ্যায়।